Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Sports

সম্পাদক সমীপেষু: বিদ্বেষের আখড়া

বত্রিশ বার সন্তোষ ট্রফি বিজয়ীর শিরোপা পাওয়া বাংলার ঘরে গত পাঁচ বার ট্রফি ঢোকেনি। ২০১৬-১৭ মরসুমে শেষ বার ট্রফি এসেছিল।

sports

— ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ ০৫:৩৭
Share: Save:

সেখ সাহেবুল হকের প্রবন্ধ ‘শেষ অবধি ফুটবলই জিতুক’ (৯-৩) প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা। আমবাঙালির ফুটবল প্রেম নিয়ে প্রবন্ধকারের পর্যবেক্ষণ যথার্থ। ঘটি-বাঙালের রেষারেষি বরাবরই ছিল, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তা একেবারে চরম আকার ধারণ করেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলার দুই প্রধান ফুটবল ক্লাবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ফেসবুক পেজ ও গ্রুপগুলি কী ভাবে পরিণত হয়েছে একে অপরের প্রতি খোলাখুলি বিদ্বেষ ছড়ানোর আখড়ায়। যেখানে বিপক্ষ ফুটবলার-কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ সমর্থক, কেউ রেহাই পাচ্ছেন না অসহনীয় ট্রোলিং-হেনস্থার হাত থেকে। দুই ক্লাবেরই মালিকানা বদল, নামকরণ ইত্যাদি নিয়ে ক্রমাগত কটূক্তি করা হচ্ছে। এই ভাবে এক বড় অংশের বাঙালি সমর্থক আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। আজ দুই প্রধানেই বাঙালি খেলোয়াড়ের সংখ্যা কিন্তু হাতেগোনা। ক্রমাগত বিদেশি কোচকে নিয়োগ করা হচ্ছে। ভূমিপুত্র বাঙালিদের বাদ দিয়ে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের। এমনকি এ-ও দেখা যাচ্ছে, কী ভাবে ভিন রাজ্যের সহকারী কোচ তাঁর রাজ্যের মাঝারি মানের খেলোয়াড়কে দলে সুযোগ দিচ্ছেন। বত্রিশ বার সন্তোষ ট্রফি বিজয়ীর শিরোপা পাওয়া বাংলার ঘরে গত পাঁচ বার ট্রফি ঢোকেনি। ২০১৬-১৭ মরসুমে শেষ বার ট্রফি এসেছিল। এগুলো নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে।

সৌম্য বটব্যাল, দক্ষিণ বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

দৈন্যদশা

সেখ সাহেবুল হকের প্রবন্ধ এবং ঋজু বসুর ‘নারান ও টোলুবাবু’ (১০-৩)— ফুটবলের উপর লেখা প্রবন্ধ দু’টি সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রসঙ্গে কিছু বলার জন্য এই চিঠি। ফুটবল বাঙালির ভালবাসা, বাঙালির প্রাণ। ছোট থেকে শুনে আসছি ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’। ফুটবল নিয়ে উত্তম, জয়া, পার্থ অভিনীত ছবি ধন্যি মেয়ে বাঙালির হৃদয়ে গভীর ভাবে দাগ কেটেছে। ছোটবেলায় যখন টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপ ছিল না, তখন গ্ৰামের অমূল্য সম্পদ দু’টি মাত্র রেডিয়ো থেকে ফুটবল খেলার ধারাভাষ্য শুনতাম। বেশ ভিড় জমে যেত সেই রেডিয়ো দু’টিকে ঘিরে। ধারাভাষ্য শোনার সময় উত্তেজনার বশে কারও কারও ‌হাত-পা চলত। মুখে কথার তুবড়ি ছুটত। এ জন্য ঝামেলা কম হত না। সে সময় আমাদের গ্রামে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকও ছিল। তাঁদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হত। কিন্তু তার বাইরে কোনও কিছু দেখিনি বা শুনিনি। তখন দৈনিক পত্রিকার খেলার পাতা ছিল ফুটবলপ্রেমীদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। ক্লাবে ওই পাতাটি পড়ার জন্য একেবারে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।

এ কথা অনস্বীকার্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে ক্রীড়া জগতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখানে ধর্ম, জাতপাত, অর্থনৈতিক বৈষম্যকে বিশেষ আমল দেওয়া হয় না। বর্তমানে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এগুলো দেখা দিলেও ক্রীড়াবিদ এবং শুভানুধ্যায়ী মানুষ এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠছেন। এক সময় বাংলা উপহার দিয়েছে প্রচুর নামী ফুটবলার। গোষ্ঠ পাল, চুনী গোস্বামী, শৈলেন মান্না, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, মহম্মদ হাবিব, শ্যাম থাপা, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃশানু দে, সুব্রত ভট্টাচার্য— এঁরা এক সময় কলকাতার মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আমাদের ছোটবেলায় স্কুলে ফুটবল খেলা হত। ক্রিকেট তখনও সে ভাবে জনপ্রিয় হয়নি। কিছু ফুটবল পাগল শিক্ষক ছিলেন, যাঁরা ভাল খেলোয়াড়ের খোঁজে বিভিন্ন স্কুলে, ক্লাবে, খেলার মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। ভাল ফুটবলার পেলে তাঁকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিজের স্কুলে নিয়ে আসতেন। রাজ্যের ছোট ক্লাবগুলোর ফুটবল কোচ খেলোয়াড় তৈরি করতেন, যাঁরা পরবর্তী কালে বড় বড় ক্লাবে খেলতেন। গাঁয়ে-শহরে ‘খেপ’ খেলতে যাওয়া ছেলে ছিল অনেক। ‘খেপ’ খেলতে যাওয়া ছেলেদের বেশ সুনাম ছিল, কিছু উপার্জনও ছিল।

সোজা কথায়, আমরা ‘ফুটবল’-কে বিদেশিদের দান করে দিয়ে এখন দর্শক-শ্রোতা হয়ে গলা ফাটাচ্ছি। তাই আমাদের গর্বের মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান ক্লাবে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা অতি নগণ্য। এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলি দৈন্যদশা কাটাতে কর্পোরেট সংস্থার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলি তো আমাদের দেশের। তাদের ইচ্ছে হয় না, বাংলা তথা দেশের ছেলেদের ভাল প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দিতে? সম্প্রতি যুবভারতীতে ডার্বি ম্যাচ ছিল। মোহনবাগান ৩-১ গোলে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছে। প্রতিটি সংবাদপত্রে দিমিত্রি, কামিংসের যুগল ছবি। কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে, বিদেশি খেলোয়াড়দের উপর নির্ভর করে আমাদের ভালবাসার ক্লাবগুলো চলছে। যে অবস্থা চলছে, তাতে দেশীয় খেলোয়াড় শূন্য হতে বেশি দেরি নেই। দেশের মানুষ ফুটবল খেলা ভালবাসলেও আমাদের দেশ এখনও বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। তার মূল কারণ, ফুটবল খেলাকে আমাদের দেশে ক্রিকেটের মতো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই খেলার উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ অত্যন্ত কম। অধিকাংশ জায়গায় সঠিক মাপের মাঠ নেই। নেই খেলোয়াড়দের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এই খেলার খেলোয়াড়রা অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের। বাড়িতে তাদের উপযুক্ত খাবার জোটে না। খেলার জন্য পোশাক, বুট কেনার ক্ষমতা থাকে না। তা হলে আমাদের দেশ বা রাজ্য উচ্চ মানের খেলোয়াড় পাবে কোথা থেকে? আশা করি, কর্পোরেট সংস্থা, ফুটবল কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার বিষয়টি সহানুভূতি সহকারে বিবেচনা করবে।

রাজ্য ফুটবলের যে দৈন্যদশা আজ আমরা দেখছি, তা যেন পরবর্তী কালে আর দেখতে না হয়, সে দিকেও নজর দিতে হবে।

গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

ফুটবলের জয়

সেখ সাহেবুল হক-এর প্রবন্ধটি বাঙালির ফুটবল প্রীতি নিয়ে কিছু অপ্রিয় সত্যের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কিছু কথা বলা জরুরি। দেশের খেলার জগতে প্রচারের প্রায় সব আলো শুষে নেওয়া এবং আর্থিক প্রাচুর্য ও জৌলুসে ভরা ক্রিকেট নিয়ে চরম উন্মাদনা সত্ত্বেও, ডার্বি ম্যাচে দর্শক-পূর্ণ যুবভারতী স্টেডিয়ামই বাঙালির ফুটবল প্রীতির সেরা বিজ্ঞাপন। আজকাল বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে বিশ্বকাপ কিংবা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, লা লিগা, কোপা আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল খেলার সরাসরি সম্প্রচার দেখার পরেও, কলকাতার ময়দানে ক্লাব স্তরের ফুটবল খেলার প্রতি দর্শক সমর্থকরা তাঁদের গভীর ভালবাসা ও একাত্মতা অটুট রেখেছে। এই খেলাকে কেন্দ্র করে ফুটবলপ্রেমী দর্শক-সমর্থকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনাবোধ, উন্মাদনা, উল্লাস যাপন, আবেগ প্রদর্শন, ক্ষোভ-হতাশার বহিঃপ্রকাশ সহজাত এবং স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে কলকাতায় ক্লাব ফুটবলের ম্যাচ চলাকালীন এক শ্রেণির দর্শক-সমর্থকদের অশ্রাব্য শব্দ সহযোগে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন, ম্যাচ শেষে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব সমর্থকদের উপর শারীরিক আক্রমণের মতো প্রতিহিংসামূলক আচরণ শুধু নিন্দনীয়ই নয়, অসহনীয়ও বটে। এ ছাড়া ভার্চুয়াল মাধ্যমেও চলে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের উদ্দেশে কদর্য মিম ও স্লোগানের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সে ক্ষেত্রে, রসনায় ইলিশ কিংবা চিংড়ি— দুটোই স্বাদহীন লাগে।

প্রসঙ্গত, প্রতি দিন অফিস-ফেরত আকাশবাণী ভবনের পাশ দিয়ে ইডেনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে ফুটপাত ধরে হেঁটে আসার সময় ওই পাঁচিলের গায়ে ১৯৮০ সালের ১৬ অগস্টের ফুটবল-দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের নামফলকগুলো চোখে পড়ে। প্রতি বছর ওই দিন দুর্ঘটনায় মৃত ফুটবলপ্রেমীদের স্মরণে সাদা ফুল দিয়ে ওই নামফলকগুলো সাজানো হয়। প্রার্থনা করি, বাঙালির ফুটবল উন্মাদনা যেন কখনও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। ফুটবল জিতুক, কিন্তু কখনওই উন্মাদনার আতিশয্যে মানবতাবোধকে হারিয়ে নয়।

অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sports Social Media Hatred
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE