আজ ৭ সেপ্টেম্বর, যে দিন এলে, স্মৃতির চড়াই পাখিরা বলে ওঠে ‘কেউ কথা রাখেনি’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কথা না রেখে আজকের জন্মদিন আর প্রয়াণদিনকে (২৩ অক্টোবর) এক ঋতুতে সমাসীন করে চলে গিয়েছেন, তাও এক যুগ অতিক্রান্ত। অবশ্য, আজ সেই সময় উপনীত যখন পুরাতন যাবতীয় মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে, বাজারের তালে তাল মিলিয়ে নব্য-বাঙালির কথা-না-রাখার অভ্যাস আর মিথ্যাচারের রঙিন মোড়কে তাকে অভিনব করে দেখানোর খেলা নতুন শতকের রক্তস্রোতে বহমান। দূরদর্শী, স্পর্শকাতর সুনীল তাই এক দিন লিখেই ফেলেছিলেন— “ইন্টারনেটে দেখি বিশ্বকে…/ আমার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না এই সেঞ্চুরিটা।”
মনে পড়ে যায়, ফেলে আসা শতাব্দীর শেষ লগ্নে ছোট-বড় লাইব্রেরিগুলি হয়ে উঠেছিল আমাদের বিশ্ববন্ধু। সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— ছোটদের, বড়দের সবার মনেই। গ্রন্থাগারের বই-তালিকায় সব থেকে বেশি ‘এন্ট্রি’ বোধ হয় তাঁরই। লাইব্রেরিয়ান আবার ‘নীললোহিত’-এর নামে আলাদা পাতা বরাদ্দ করলেও ব্র্যাকেটে ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ লিখে রাখতেন। ছোটদের জন্য সবুজ দ্বীপের রাজা বা কাকাবাবুর অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার, আর সাধারণ পাঠকের জন্য পূর্ব পশ্চিম, সেই সময়, প্রথম আলো-র মতো বইয়ের অন্তত দু’টি-তিনটি করে সেট রাখতে হত! লাইব্রেরি পরিচালন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে পাঠকদের মিটিংয়ে যত বইয়ের প্রস্তাব আসত তা এক কথায় সুনীলময়। সদ্য গ্র্যাজুয়েট তরুণী তখন রিল-ডাঙার ক্যাফে-মুখী কন্যে হয়ে ওঠেননি, বদলে সাতাশে আটকে থাকা নীললোহিতের হাত ধরে তাঁর একমাত্র গন্তব্য ছিল দিকশূন্যপুর। সেই সব দিন বুঝি আজ মহাশূন্যের বিপুল অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে।
গদ্যশিল্পী সুনীলের কাছে কবি সুনীল পরাজিত, নাকি তাঁরা পরস্পরের পরিপূরক— এই তর্কে দ্বিতীয় প্রস্তাবের পাল্লা ভারী। কবিতায় তিনি আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখেন প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির মধুর দ্বন্দ্ব। ‘নীরা’কে ভালবেসে যাওয়া কবির মতো আমাদেরও নিয়তি, তাকে না-পাওয়াই আসলে পরম পাওয়া।
ছোটবেলায় আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হত বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার। মা-কে উৎসর্গ করেছিলেন সুনীল এই বইটি। সক্রেটিস, খ্রিস্ট, দান্তে, গগ্যাঁর মতো স্মরণীয় মানুষদের পরিণতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। হয়তো তখনই জানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন জীবন সহজলভ্য বস্তু নয়, স্মরণীয় যাঁরা তাঁদের পথ অনুসরণে কাঁটা বেঁধাই দস্তুর। এর পাশাপাশি যখন ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ বা অন্য কিছু রচনা পড়ি, তখন বুঝতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আজীবনের শব্দসাধনায় ফেলে আসা সময়ের প্রেক্ষাপটে সমসময়কে বুঝতে চেয়েছেন, দু’টি সময়ের মধ্যে সেতুর ভূমিকা পালন করতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে অসম্ভব জনপ্রিয়তার মধ্যে নির্বিকার থেকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন— ‘বিখ্যাত’ শব্দের সঙ্গে শব্দরথীর কোনও সম্পর্ক হতে পারে না। ওটা নতুন শতকের ‘নেশাদ্রব্য’, একটা একবিংশীয় অপঘাত। বরং এই জনারণ্যে এক জন হয়ে থাকাই সাহিত্যরথীর কাঙ্ক্ষিত নিয়তি। সুনীল-সাহিত্য-সমুদ্র তাই ফিরে ফিরে মন্থন করতে হবে, হবেই।
শুভাশিস চক্রবর্তী, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
আজও আঁধার
‘মহম্মদ সিরাজ, আপনাকে’ (১১-৮) প্রবন্ধে ঈশানী দত্ত রায় সময়োপযোগী বিষয় উত্থাপিত করেছেন। তা একেবারে হৃদয়ে রক্তপাতের মতো। সে আঘাত যথার্থই। আমাদের ভাবায়, বিরোধী দলনেতা কেনই বা আজ এ দেশের প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুরে হিন্দুত্ব নিয়ে এত আগ্রাসী? কেনই বা এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ মন্দির বা দুর্গা ভবন তৈরিতে এত গভীর মনোনিবেশ করলেন?
মহম্মদ সিরাজ বিধ্বংসী বোলিংয়ের মাধ্যমে ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ়ে ড্রয়ের দাগ কাটলেন। তাই তাঁর নামে জিন্দাবাদ। তা না হলে? বিবেকের ভূমিকায় শুধিয়েছেন প্রবন্ধকার। মনে করিয়েছেন, আসল পরিচয় তিনি এক ভারতীয় ক্রিকেটার। এখানে জাত-ধর্মের পরিচয় মুখ্য নাকি? এটাই তো বর্তমানে মূল সমস্যা। যুক্তিবোধের স্থান দখল করেছে অন্ধতা, কূপমণ্ডুকতা, ধর্মান্ধতা প্রভৃতি। অনুশীলনকারীরা কিন্তু পোশাকে-আহারে-বিহারে আধুনিক। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এঁদের করায়ত্ত। গর্বের সঙ্গে বলবেন, আমরা একবিংশ শতাব্দীর মানুষ। অথচ কে না জানে, বাঙালির গর্ব তথা ভারতীয়দের গর্ব রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ আঠারো বা উনিশ শতকের মানুষ হয়েও দেশে নবজাগরণের মাধ্যমে আধুনিক মননের সূচনা করে গিয়েছিলেন। এঁদের চিন্তার মর্ম বুঝলে আজ হিন্দু-মুসলমান নিয়ে এমন বিভাজন সৃষ্টি করতে পারতেন না।
একদা হিন্দু-মুসলমান তাস খেলেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আজও যাঁরা এই একই তাস খেলে যাচ্ছেন, তাঁরা কি এই সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর? হয়তো তাই। শুধু এ রাজ্যে নয়, সারা দেশে শুনতে হয় ক্ষুধা, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাবের কথা, নারী নির্যাতন, দুর্বলের উপর নিগ্রহ, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্মম অত্যাচারের করুণ কাহিনি। এ সব কিছুকে ভুলিয়ে দিতেই ব্রিটিশের কায়দায় হিন্দু-মুসলমানে বিভাজনের কৌশল নাকি? প্রসঙ্গত, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণ শতবর্ষে তাঁর একটি উক্তি স্মরণীয়। “আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বাস্তবিক কোন অসদ্ভাব নাই। স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে কয়েকজন স্বার্থপর ব্যক্তির প্ররোচনায় একটা অসদ্ভাব সৃষ্টি করিবার চেষ্টা হইয়াছিল মাত্র। সে-চেষ্টাও ব্যর্থ হইয়াছে... আমি দেখিয়াছি মুসলমান ও হিন্দু চাষাদের মধ্যে সম্বন্ধ আছে। দাদা, চাচা, মামু বলিয়া তাহারা পরস্পর পরস্পরকে সম্বন্ধ সূত্রে বাঁধিয়া লইয়াছে। তাহারা একই রকম কাজ করে, একই ভাষায় কথা বলে, এবং তাহাদের আচার ব্যবহার অনেকটা একই রকম।” আজও এ কথাই বলা যায় যে, এ দেশে ক্ষমতাসীন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি পরিকল্পিত ভাবে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সৃষ্টি করছে।
তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-৯
ক্রিকেট সন্ন্যাসী
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে স্বভঙ্গিমায় নীরবে প্রস্থান করলেন দ্রাবিড়-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দ্য ওয়াল’ চেতেশ্বর পুজারা। তাৎক্ষণিক বিনোদনের কাঁটায় যখন আজকের ক্রিকেট-দুনিয়া মজে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের গ্রাসে যখন হাঁসফাঁস করছে আজকের তরুণ প্রজন্ম, যখন একটা আইপিএল চুক্তিই হয়ে উঠছে নব্য প্রতিশ্রুতিমানদের শেষ চাঁদমারি, তখন ভারতীয় ক্রিকেটে সুনীল গাওস্কর, রাহুল দ্রাবিড় ঘরানার শেষ প্রতিনিধি হিসেবে বটগাছের মতোই দাঁড়িয়ে ছিলেন চেতেশ্বর পুজারা। ধৈর্য, স্থৈর্য এবং প্রতিরোধ— এই তিনটি শব্দকে ক্রিকেটের অভিধানে পুনরায় জীবিত করেছিলেন। পুজারা মানেই এক দর্শন, এক মূল্যবোধ, এক বিশ্বাস। তাঁর আসল পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে ব্যাট হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিখুঁত নিষ্ঠার অনুশীলনে, অসংখ্য আঘাত সত্ত্বেও ব্যাট নামিয়ে না রাখার জেদে, আর প্রতিপক্ষ বোলারের প্রতিটি গোলার সামনে অটল প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকায়। ক্রিকেট তাঁকে মনে রাখবে দ্রাবিড়ের প্রকৃত উত্তরপুরুষ রূপে।
টেস্ট ক্রিকেটের নিষ্ঠাবান পূজারি পুজারা বুঝিয়েছেন— ক্রিকেটের আত্মা এখনও টেস্ট ক্রিকেটেই বেঁচে। যে যুগে খেলোয়াড়রা নিজেদের গড়ে তুলছেন স্বল্প সময়ের বিনোদনের উপযোগী করে, পুজারা দেখিয়েছেন অপরিসীম ধৈর্য, নিখাদ নিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগের মহিমা। দেখিয়েছেন— ক্রিকেট কেবল শটে নয় বরং আঘাত সহ্য করার ক্ষমতায়, আত্মত্যাগে, দলের জন্য নিজের শরীরকে বলি দেওয়ার মানসিকতায় মহত্ত্বের দিশা দেখায়। তাঁর কেরিয়ার শিখিয়ে গেল, প্রতিরোধও এক মূল্যবোধ এবং সেটিই আসল শক্তি। বিরল এই ক্রিকেট সন্ন্যাসীর অবসরে ভারতীয় ক্রিকেটের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ও যেন সমাপ্ত হল।
সুদীপ সোম, হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)