প্রয়াণসংবাদ ‘বিদায় প্রফুল্ল রায়ের’ (২০-৬) নিয়ে কিছু কথা। ‘বিষয় বৈচিত্রে ঈর্ষণীয় পরিধি ছোঁয়া’ সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের যথার্থই মূল্যায়ন করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনে তাঁর লেখায় প্রাপ্ত অসামান্য ইতিহাস চেতনার বিষয়ে সম্যক আলোকপাতের অপর্যাপ্ততা মনকে পীড়া দিল। বিশেষত তাঁর বহুলপরিচিত কেয়াপাতার নৌকো দেশভাগের শিকার বাঙালি উদ্বাস্তু মানুষের যন্ত্রণাদীর্ণ যাপন চিত্র যে ভাবে চিত্রিত হয়েছে তা কেবল বাংলাসাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যের নিরিখেও বিরল। উপন্যাসটি তিনি প্রথমে ধারাবাহিক রূপে অধুনালুপ্ত অমৃত পত্রিকায় লিখেছিলেন। পরে শতধারায় বয়ে যায় এবং উত্তাল সময়ের ইতিকথা নামে আরও দু’টি পর্ব লেখেন। নিঃসন্দেহে এই ট্রিলজিটি বাংলাসাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান ক্রান্তিকাল উপন্যাসের জন্য।
জীবিকার প্রয়োজনে এক সময়ে তাঁকে সারা ভারত ঘুরতে হয়েছিল। থেকেছেন ও মিশেছেন বিচিত্র মানুষের সঙ্গে। তাই নাগাল্যান্ডের জনজাতির সমাজ থেকে বিহারের প্রান্তিক মানুষ তাঁর লেখার বিষয় হতে পেরেছে। আন্দামানের ছিন্নমূল মানুষের নতুন করে বেঁচে ওঠা থেকে পশ্চিম উপকূলের জেলেদের জীবনসংগ্রাম তাঁর লেখার উপজীব্য হয়েছে। বেদে সম্প্রদায়ের অদ্ভুত যাপন কাহিনিও জানা যায় তাঁর উপন্যাস পড়ে। তাঁর লেখায় বাদ যায়নি বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন ও যাপন চিত্র-ও। তাঁর যেমন ছিল দেখার চোখ, তেমন ছিল সংবেদনশীল মনন। তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্প পড়ে যুগপৎ তৃপ্ত ও সমৃদ্ধ হয়েছেন পাঠক, আর ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য।
গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে যখন বাংলা চলচ্চিত্রের ধারা সাহিত্য-আশ্রিত ছিল, তখন প্রফুল্ল রায়ের বেশ কিছু পাঠকপ্রিয় উপন্যাস সেলুলয়েডে বন্দি হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত তাঁর উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্য লিখেছেন পুত্র সন্দীপের পরিচালিত ছায়াছবির জন্য। আবার তপন সিংহ বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো একাধিক পরিচালকও তাঁরই কাহিনি অবলম্বনে ছবি নির্মাণ করেছেন। খুব জনপ্রিয়ও হয়েছে সেই সব শিল্প। কিছু ছবি পেয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পুরস্কার।
প্রফুল্ল রায়ের প্রয়াণ ঘটেছে বটে, কিন্তু তাঁর লেখার কাছে বাংলার পাঠক সমাজকে বার বার যেতে হবে। সে তো যেতে হবেই। তিনি যে সকল শ্রেণির মানুষের কথাকার ছিলেন।
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
ওই রত্নভান্ডার
প্রফুল্ল রায়ের যে উপন্যাসটি আমি প্রথম পড়ি, তার নাম দায়দায়িত্ব। চমকে গিয়েছিলাম উপন্যাসের ঘটনা এবং লেখার টানটান ঋজু ভঙ্গিতে। এক নারীর অসহায়তা, পাশাপাশি একই সঙ্গে মানুষের পৈশাচিকতা এবং মহানুভবতার যে যুগপৎ অতুলনীয় চিত্র সে উপন্যাসে লেখক এঁকেছিলেন, তার তুলনা মেলা ভার। আর রচনাভঙ্গি এত জীবন্ত, পড়তে শুরু করলে ছাড়ে কার সাধ্য! শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাঠকের স্বস্তি নেই। একেবারে বুঁদ হয়ে সব ভুলে পড়া যাকে বলে। এর পরই কৌতূহল বেড়ে গেল লেখক সম্পর্কে। একে একে শেষ করলাম মহাযুদ্ধের ঘোড়া, অন্ধকারে ফুলের গন্ধ, আকাশের নীচে মানুষ, দাঙ্গা দেশভাগ এবং তারপর, হারিয়ে যাওয়া লেখা।
দেখলাম, শুধু প্রথম-পঠিত উপন্যাসটিই নয়; তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-স্মৃতিকথা অনবদ্য প্রসাদগুণসম্পন্ন ও জীবনসত্যের দ্যোতক। দেশভাগের পটভূমিকায় লেখা মর্মস্পর্শী আখ্যান তাঁর কেয়াপাতার নৌকো ত্রয়ী— কেয়াপাতার নৌকো ও অপর দু’টি খণ্ড— শতধারায় বয়ে যায় এবং উত্তাল সময়ের ইতিকথা। উপন্যাস-পর্বগুলি হালের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে গণ্য হওয়ার যোগ্য।
পূর্ব-পার্বতী তাঁর খুবই উল্লেখযোগ্য রচনা। ভারতের উত্তর-পূর্বের নাগা সম্প্রদায়ের জীবনভিত্তিক এই উপন্যাসে মানুষ ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার। লেখকের অবিস্মরণীয় বর্ণনা— “ওপরে অবারণ আকাশ। তার নীল রঙে আশ্চর্য ক্রুরতা। কোথায়ও দু এক টুকরো মেঘের ভ্রুকুটি ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের চড়াইটা ঘিরে এখনও সাদা কুয়াশার একটা চিকন রেখা স্থির হয়ে রয়েছে।
“বাঁ দিকে অবিন্যস্ত ওক্ বন আর আপুফু গাছের জটিল জটলা। সহসা তার মধ্য থেকে ফুড়ে বেরিয়ে এলো দুটি বন্য মানুষ। ঘন তামাভ গায়ের রঙ। বিশাল বুকে, অনাবৃত বাহুসন্ধির দিকে থরে থরে পেশীভার উঠে গিয়েছে। স্ফীত নাক, মোটা মোটা ঠোঁট। আর ভাসা ভাসা দুটি পিঙ্গল চোখের মণিতে আদিম হিংস্রতা। কানের ওপর দিয়ে সারা মাথায় চক্রাকার রেখা টেনে চুল কামানো। খাড়া খাড়া উদ্ধত চুল; দুটি কান আর ঘাড়ের ওপর কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়েছে। বিরাট থাবায় দুজনেই মুঠো করে ধরেছে জীম্বো পাতার মত তীক্ষ্ণমুখ বর্শা। মোটা মোটা আঙুলের মাথায় খরধার নখের মুকুট। বর্শার লম্বা বাঁশে সেই নখগুলি স্থির হয়ে বসেছে। সারা মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। গাল, চিবুক আর গলার রাজ্য থেকে তাদের নির্মূল করা হয়েছে। সচ্ছিদ্র কানে পিতলের গোলাকার গয়না। সারা দেহ অনাবরণ। একজনের কোমরের চারপাশে হাতখানেক চওড়া পী ম্যুঙ, কাপড়। গাঢ় কালো রঙের প্রান্তে ঘন লালের আঁকিবুকি। পরিষ্কার কোমার্যের সঙ্কেত। আর, একজনের পরনে জঙগুপি কাপড়; একেবারে জঙ্ঘার সীমানায় নেমে এসেছে। গাঢ় নীল রঙের ওপর চারটে সাদা সাদা দাগ। সেই সাদা দাগের আড়াআড়ি চারটে লাল রেখা আঁকা। বিবাহিতের পরিচয়। সেই সঙ্গে বোঝা যায়, মানুষটা প্রিয়জনদের অনেকগুলো ভোজ দিয়ে জঙগুপি বস্ত্রের সম্মান অধিকার করেছে।”
এই বর্ণনা হয়তো কিঞ্চিৎ দীর্ঘায়িত, কিন্তু পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার কোনও জায়গাই লেখক রাখেননি— এমনই দক্ষতা, তেমনই গতি তাঁর কলমে।
অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য মোহনার দিকে, আমাকে দেখুন, সম্পর্ক, ক্রান্তিকাল, সিন্ধুপারের পাখি। তিনি অজস্র ছোট গল্পও লিখে গিয়েছেন। মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় ‘জন্মদাত্রী’, ‘মাঝি’, ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘অনুপ্রবেশ’, ‘শিকড়’ প্রভৃতি কাহিনি পড়ে; আবার ‘নরকের পোকা’ পড়ে হতাশও হয়েছি।
দেশভাগ এবং হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নিয়ে লেখা উপাখ্যানের এক সার্থক রূপদাতা প্রফুল্ল রায়। ছোটদের জন্যও কলম ধরেছেন। লেখকের জীবন তাঁর লেখনীর মতোই বিচিত্রগামী। প্রায় সমগ্র ভারত ভূখণ্ড, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ চষে বেড়িয়েছেন। তুলে এনেছেন সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা, তাদের সুখ-দুঃখ, ক্রোধ-হিংসা-লালসা, প্রেম-ভালবাসার চিত্র। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিশেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে। তাই সেগুলি এত জীবন্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে।
অনেক সমালোচক বলতেন, উনি তো সিনেমা তৈরি জন্য গল্প লেখেন। অর্থাৎ যে-হেতু তাঁর কাহিনিতে গতি থাকে, ঘটনার ঘনঘটা থাকে, কাজেই তা উচ্চস্তরের শিল্প নয়— এই এঁদের অভিমত। কোথা থেকে এই মতবাদ এল, কে জানে!
সুখপাঠ অনুভব বজায় রেখেও যে উচ্চস্তরের সৃষ্টি করা যায়, বাংলা সাহিত্যে যে মুষ্টিমেয় লেখক কঠিন সে কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন, অনন্য কথাসাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। তাঁর প্রয়াণসংবাদে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।
সুগত ত্রিপাঠী, সুয়াদিঘি, পূর্ব মেদিনীপুর
ঠিক তথ্য?
‘বিদায় প্রফুল্ল রায়ের’ প্রয়াণসংবাদের মধ্যে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্যগত বিভ্রান্তি লক্ষ করে ব্যথিত হয়েছি।
সংবাদে বলা হয়েছে, প্রফুল্ল রায়ের জন্ম ডায়মন্ড হারবারে। কিন্তু তাঁর বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক-পরিচিতি অংশে এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া গেল না। এমনকি, তাঁর স্মৃতিকথা যখন যা মনে পড়ে-র কোথাও তাঁর লেখার মধ্যে এর ইঙ্গিতও নেই। এই বইটির একাংশে লেখা হয়েছে, প্রফুল্ল রায়ের জন্ম ১৯৩৪-এ। আদি নিবাস অখণ্ড বাংলার ঢাকা জেলায়, বিক্রমপুরের আটপাড়ায়। এ ছাড়াও এই সংবাদে তাঁর আকাশের নীচের মানুষ নামের একটি উপন্যাসের কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু এই নামের কোনও উপন্যাস তো প্রফুল্ল রায় লেখেননি; লেখাটির নাম আকাশের নীচে মানুষ।
রাহুল ঘোষ, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)