সায়ন্তনী সেনগুপ্তের লেখা ‘রেস্তরাঁর বিলের উপরে লেখা লতার জন্য গান’ (রবিবাসরীয়, ২৫-৫) শীর্ষক আলোচনাটি অসাধারণ। প্রথিতযশা গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভা সম্পর্কে প্রবন্ধকারের বিশ্লেষণ সুন্দর এবং স্মৃতিচারণ নিখুঁত। মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই তাঁর বিপুল প্রতিভার পরিচয় মিলেছিল, তার পর যে ভাবে কালে কালে তার বিস্তার হয়েছে, তা অভাবনীয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, কিশোরকুমার, অখিলবন্ধু ঘোষ, নির্মলা মিশ্র, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ দিকপাল শিল্পীর গলায় শোনা একের পর এক হিট গানের কালজয়ী অবস্থান ও তার সংখ্যাই বলে দেয় তাঁর মতো গীতিকারের স্থান কোথায়। বাঘা বাঘা সঙ্গীত বিশারদের কাছেও তাঁর লেখা ও সুর করা গান যথেষ্ট সমাদর পেত। আর তৎকালীন শিল্পী-মনে কিংবা শ্রোতার অন্তরমহলে তাঁর উপস্থিতি ছিল বড়ই অনায়াস।
সঙ্গীত রচয়িতা হিসাবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় চলার পথে বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। আর খ্যাতির শীর্ষে ওঠার পথের সন্ধানে গেলে অনেক চমকপ্রদ ঘটনার কথা জানা যায়, যা আজ কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। তারই বেশ কয়েকটির বিষয়ে জানিয়েছেন লেখিকা। তাঁর বহু গান আজও সঙ্গীত অনুরাগী শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। গানের নেপথ্যের কাহিনিও অতি স্বাদু, ক্ষণজন্মা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন হয়। সৃষ্টির মূলের সেই ঘটনাগুলি যেন শিল্পের মহত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করে। কিশোরকুমার স্বভাবসিদ্ধ অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বলেছেন, তাঁর গান ছিল “একেবারে তালমিছরির মতো মিষ্টি”। কোন গান তিনি লেখেননি! আধুনিক রোম্যান্টিক গান থেকে শুরু করে শ্যামাসঙ্গীত বা আলি আকবর খানের সুরে গান বাঁধা পর্যন্ত সঙ্গীতজগতের সব কোণে তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল।
কিন্তু কোনও কোনও বেদনা চিরকালের ক্ষত হয়ে থেকে যায়। এত গান শোনার পরও কলমধারী মানুষটির মনের খবর পায়নি শ্রোতারা। গীতিকার-সুররসিক পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপ্রত্যাশিত অকালমৃত্যুতে সমগ্র সঙ্গীতমহলে ও হাজার হাজার সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতার মনে নেমে আসে শোকের ছায়া। তাঁর চলে যাওয়ার সেই দিনটি কোনও ভাবেই ভোলা যায় না। যদিও সেই অন্তিম ক্ষণটি কেউ মনেই রাখতে চাইবেন না। তবে তাঁর অকালমৃত্যুতে সমগ্র সঙ্গীতজগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা আজও যেন পূর্ণ হয়নি।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদিয়া
গানের বিভা
হলে শ্রোতা সমাগম দেখে যেমন একটা আন্দাজ পাওয়া যায় কী হতে যাচ্ছে অনুষ্ঠান, তেমনই প্রকৃত শিক্ষক অনেকের ভিড়ে অদীক্ষিত গলার গান শুনেও ধরতে পারেন, এর দ্বারা কত দূর কী হবে। শুভ গুহঠাকুরতার এই মন্তব্য আশির দশকের।
এই সময়ের মাস্টারমশাইরা এত বাছ-বিচারের সময় পান কি না জানা নেই। কিন্তু সে কালে গান শেখা আর শোনার এটাই ছিল পারিপার্শ্বিক। এক নবীনার গান শুনে দেবব্রত বিশ্বাস বললেন, “গান আপনে মায়ার কাছে শিখে নেন, তয় প্রেসেন্টেশন আমি দ্যাখায় দিমু। আর গাইবার সময় এত নড়াচড়া করেন ক্যান? এ চলবে না।” শুনে থ আগরতলার সেই একরত্তি কন্যে। জন্মে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেননি, শুনেছেনও কম। জন্মস্থান আগরতলায় গুরুরা বরাবর শাস্ত্রীয় গানে তালিম দিয়েছেন। দেখেছেন ত্রিপুরা রাজসভার সভাগায়কদের। সকলেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চায় নিয়োজিত। তাঁরা গাইতেন অঙ্গ দুলিয়ে, শাস্ত্রীয় গানের চালু বিধি মেনেই। সেটাই রেওয়াজ। ১৯৫৯-এ কলকাতায় এসে জোড়াসাঁকোয় মায়া সেনের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্লাসে ঘেমে নেয়ে একশা সেই মেয়ে। স্বরলিপির বাইরে একচুল যাওয়া যাবে না। আর কিছু গাইতে গেলেই অঙ্গ দুলিয়ে তানালাপ এসে যাচ্ছে। তবে হাল ছাড়েননি। সপ্তাহে দু’দিন যাদবপুর থেকে চিৎপুরে এসে অ্যাকাডেমিতে তালিম নিয়েছেন। তখনও বিশ্ববিদ্যালয় তকমা পায়নি রবীন্দ্রভারতী। এরই মাঝে এক দিন গুরুই ওঁকে নিয়ে গেলেন জর্জ বিশ্বাসের কাছে। গান শুনে বাহবা দিলেও মায়া সেনের সামনেই উপরের কথাগুলি সরাসরি বলে দিলেন তিনি।
আজকের শিক্ষার্থী হলে সে পরামর্শ কানে ঢুকত না সম্ভবত। কিন্তু সে দিনের সেই শিক্ষার্থী আজকের নবতিপর বিভা সেনগুপ্ত, ৯৩ বছর বয়সে যাঁর গান এবং গায়ন নিয়ে আলোচনা বিস্ময়ের সব ম্যারাথন ভাঙছে। এই সময়ের গায়ক গায়িকারা জানুন, আকাশবাণী, দূরদর্শন, রেকর্ড কোম্পানির মোহ ওঁকে কদাপি টানেনি। আগরতলার গুরুর ইচ্ছেতে কলকাতায় এসে শাস্ত্রীয় গান রেকর্ড করার ইচ্ছে থাকলেও, জানতেন না কাকে বলতে হবে। তাই ও পথ আর মাড়াননি। ডুবে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গানে। শুধু শেখা আর শেখানো, শুদ্ধতা বজায় রেখে— জীবনের এই এক ব্রত। গান গেয়ে তরী বেয়ে ভ্রুক্ষেপহীন অগ্রগামী এই জীবন এই সময়ের প্রতিষ্ঠাকামীদের সামনে রোল মডেল হতে পারে না?
পারে না বলেই মনে হয়। কেননা, শুদ্ধতা বজায় রেখে রবীন্দ্রনাথের গান সাদামাঠা গেয়ে দিচ্ছেন যাঁরা, সেই শিল্পীদল আর তাঁদের শিক্ষকরা তো আজ একঘরে। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ-র মতো বুকের পাটা এখন আর কার আছে যিনি আসরে বসেই সুখ্যাত পুত্র আর জামাইয়ের অনুষ্ঠান হাত তুলে থামিয়ে দিতে পারেন! দু’জনে মেতেছিলেন শ্রোতারঞ্জন সওয়াল জবাবে। সেই লঘুক্রিয়া মানতে পারেননি আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব। এখন কে এমনটি দেখিয়ে দেবেন? শেখানোর সময় দেবব্রত বিশ্বাস যখন কণ্ঠে ধরছেন “মিলাব নয়ন তবে নয়নের সাথে”, তখন বিভা সেনগুপ্তকে বাধ্য করছেন ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে সে গান গাইতে। ভয়ে, লজ্জায় গুটিয়ে গিয়েছেন বিভা, কিন্তু তাকাতেই হয়েছে। সেই দৃষ্টি আজও ভোলেননি বিভা, “ওই তাকানোতেই গানের মর্মবাণী বুঝে যাই আমি। এ রকম শিক্ষাই আমি পেয়েছি।” তাই কৃষ্ণকলি-র বহু বিশ্রুত শ্রবণে অভ্যস্ত শ্রোতার কান থমকে যায় বিভার কণ্ঠে কৃষ্ণকলির “আমি” শব্দের স্বরোচ্চারণে। প্রখর এবং পৃথক ব্যক্তিত্বের আরোপ সেখানে, অবলীলায় অকম্পিত কণ্ঠে সোজাসাপ্টা গেয়ে দিচ্ছেন বিভা। এ কোনও ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নয়। গলাকে সবল, সিধে রাখার একবগ্গা সাধনা একমাত্র সম্বল ওঁর, সারা জীবন তারই পূজারি। তাই আজও “আমি হেথায় থাকি শুধু”র বলিষ্ঠ পেশকারিতে তাঁর সামনে খালি রবীন্দ্রনাথ। প্রভু এখানে প্রিয়তম। তাঁর সঙ্গেই বোঝাপড়া। সেই প্রেমপথে মাঝে কোনও বাধা থাকে না। চণ্ডালিকার মা চরিত্রের নানা গানেও স্বরলিপি মেনেও একদম নিজের প্রজ্ঞায় অচঞ্চল তিনি। গান ঠিক নয়, সুরেলা সংলাপ যেন। এই চর্চা তাঁর সেরা সময়ে তেমন প্রচার পায়নি। ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন। ক্রিকেটে যেমন পদ্মাকর শিভালকর বা রাজিন্দর গোয়েল। বড় নামের পিছনে অবিরল ছায়া। কিন্তু জহুরি সাগর সেন ওঁকে চিনতে ভুল করেননি। বিভার হাতে তুলে দেন রবিরশ্মির ক্লাস চালানোর দায়িত্ব। দীর্ঘ কয়েক দশক গান শিখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছেন তিনি। এখন তাঁর অশক্ত শরীরটিকে অনুষ্ঠানে পরম আদরে নিয়ে যান অনুগত ছাত্রীরাই। এও এক দেখার বিষয়। ওঁকে মঞ্চে বসিয়ে দিয়ে সামনে হারমোনিয়াম রাখলেই হল। খাতাপত্তরের বালাই নেই। গান শুরু হয়ে যাবে।
শরীর অশক্ত হলেও যা বলার সরাসরি বলেই দেন বিভা। গানে, গানের বাইরেও। এই সময়ের এক সুরেলা নামজাদাকে সে দিন স্বরলিপির বাইরে গাইতে দেখে বাহবার ফাঁকে বলেই দিলেন, “তুমি কিন্তু স্বরলিপি মেনেও ভাল গাইবে। সেই চেষ্টা করো।” মঞ্চ দাপানো সোনার হরিণের খোঁজে ব্যস্ত গায়কের বেসুর-বিক্রম আর ‘সুন্দরী রাধে’তে সুচতুর জুড়ে দেওয়া উত্তর ভারতীয় উপশাস্ত্রীয় অম্বলে বিভ্রান্ত শ্রোতারা দু’দণ্ড জিরিয়ে নিতে চাইলে বিভা সেনগুপ্তর গানের ছায়াতলে আসুন। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ধরে বলা যায়, “পাবে ছায়া, পাবে জল, সব পাপ হবে তব শান্ত।”
অলক রায়চৌধুরী, কলকাতা-৫৫
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)