এই চিঠির প্রসঙ্গ প্রেমাংশু চৌধুরীর লেখা প্রবন্ধ ‘কতটা পুতুল হলে তবে...’ (২১-৮)। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় প্রসঙ্গে প্রবন্ধকার যা যা বলেছেন, সে কথা বোধকরি তাঁর ভক্তরাও অস্বীকার করতে পারবেন না। আসলে লাগামহীন আনুগত্যের চাপে যখন কারও মেরুদণ্ড নুয়ে পড়ে তখন তাঁর মধ্যে সংযত স্বভাবের অভাব ঘটা বিচিত্র কিছু নয়। এখন তো নজিরবিহীন ঘটনা সৃষ্টিতে কেউ কেউ এমন ভাবে মেতে উঠেছেন যে, নিজ পদের গরিমার কথা বড় একটা পাত্তা দেন না। সরকারি পদে বসে কেউ দলীয় মুখপাত্র হয়ে উঠবেন, তা যে কাম্য নয় সকলেই বোঝেন। তবে মানতে গিয়ে ভয় কিংবা পুরস্কারের হাতছানিতে কেউ কেউ বিপথগামী হয়ে পড়েন। ইদানীং মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে নিয়ে বহু অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে শাসকের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ করছেন।
সেই অভিযোগ সত্যি কি না, সেই প্রসঙ্গে না গিয়েই বলা যায়, পক্ষপাতিত্বের পরিণাম ভাল হয় না মোটেও। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কেউ কেউ অপমানিত হন। অথবা গলায় কাঁটা নিয়ে দিনযাপন করেন। অবশ্য কেউ কেউ বিদ্রোহী হয়েও ওঠেন। বিলম্ব হয়ে গেলেও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। অন্যদেরও সতর্ক করার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ বিজেপির প্রাক্তন সংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর কথা মনে পড়তে পারে।
পূর্বে এ রকমটি দেখা যায়নি। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির দ্বারা কাউকে এই ভাবে দলদাসে পরিণত হতে দেখা যায়নি অথবা কেউ ভয় কিংবা পুরস্কার লাভের প্রত্যাশী হয়ে পদের অমর্যাদা করেননি। এ বড় ভয়ানক দুর্দিন দেখতে হচ্ছে আমাদের। তাই ভরসা শুধু প্রধান ন্যায়ালয়ের প্রতি। সেখানেই আমাদের সুরক্ষা!
বাবুলাল দাসইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
চেনা ছক
প্রেমাংশু চৌধুরীর লেখা ‘কতটা পুতুল হলে তবে...’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে জগদীপ ধনখড় শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে আচমকা ইস্তফা দিয়েছেন। বিরোধীরা তো বটেই, মনে হয় এ বিষয়ে খোদ সরকার পক্ষও সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল। বোঝা যাচ্ছে, তাঁর সঙ্গে মোদী সরকারের শীর্ষ স্তরের সম্পর্কের ফাটল এতটাই যে, তাঁকে ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার কোনও অনুরোধ জানানো হয়নি।
এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এ-হেন আচমকা এই ইস্তফাই কিন্তু এই শাসকের জমানায় প্রথম ঘটনা নয়। নোটবন্দির সময়ও শোনা গিয়েছিল, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর, দুই জন নির্বাচন কমিশনার নাকি এক প্রকার সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সরকারের সঙ্গে নীতিগত বিরোধে সরতে হয়েছিল কয়েক জন আর্থিক উপদেষ্টাকেও।
এ বার ধনখড়ের ইস্তফায় খোলসা হয়ে গেল, শাসক শিবিরের কাছে তিনি কোনও কারণে গুরুত্বহীন বোঝার মতো হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের অঙ্গুলিহেলনে না চললে, যত বড়ই বৃক্ষ হোক, তাকে সমূলে উৎপাটিত করাই আজ ক্ষমতা জাহির করার এক চেনা ছক হয়ে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে, সামান্য স্বার্থে আঘাত লাগলেই মানুষটিকে অপ্রয়োজনীয় করে দিতে দু’বার ভাবেন না শীর্ষনেতারা।
দেখা যায়, কথায় কথায় শাসকরা গণতন্ত্রের নাম করে দেশবাসীর সামনে অনেক রকম তত্ত্বের অবতারণা করেন, ভারী উপদেশ শোনান। কিন্তু তাঁদের নিজেদের দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র আদৌ সজীব রয়েছে তো?
রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
মোরগের রূপকে
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘একটি মোরগের কথা’ (১৭-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটি গণতান্ত্রিক স্যাটায়ারের জ্বলন্ত উদাহরণ। কেবল ভারত নয়, এই মুহূর্তে বিশ্বজোড়া স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি মার্জিত প্রতিবাদপত্রও বলা যেতে পারে। ১৫০ বছর আগেকার একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছে। অতঃপর আজকের ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ছবিটি সাধারণের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রবন্ধের একেবারে শেষের কিছু বাক্যে প্রবন্ধকার গণতন্ত্রের গোড়ার কথাটি মনে করিয়েছেন।
কেবল ভোটের দিনেই জনগণের গুরুত্ব! ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে এর চেয়ে কঠিন সত্য আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেকার কথা। সে দিনও বলিপ্রদত্ত বাঙালি মোরগের কথা শুনিয়েছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। শতবর্ষ পরে এসেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। সাধারণের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসেনি। তবে ১৫০ বছর আগে জাস্টিস পত্রিকায় ইংল্যান্ডে যে মোরগ ধরা পড়েছিল, তার সঙ্গে বাঙালি কবির মোরগের বেশ তফাত আছে। বাংলার মোরগটি ভাবতে পারেনি ভালবাসা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, ভরসা দিয়ে গড়ে তোলা মালিকই এক দিন তাকে ভোজের টেবিলে নিয়ে যাবে! ইংল্যান্ডের মোরগ কিন্তু জানত, মরতে তাকে হবেই। কেবল “কোন সস দিয়ে খাওয়া হবে সেটাই ছিল তার ভাবনার বিষয়।” সে দিক দিয়ে বিদেশি মোরগ ভাগ্যবান। অন্তত প্রিয়জনের কাছে সে ঠকে যায়নি। প্রশ্ন, বিদেশি মোরগ স্বপ্ন না দেখলেও দেশি মোরগ তো স্বপ্ন দেখেছিল। মালিক তার সেই স্বপ্নের মূল্য কি দিতে পেরেছিল? পারেনি। এর কারণ কী? কারণ হল বোঝাপড়া। মালিকের সঙ্গে মোরগের। যুগযুগান্ত ধরে এই মোরগরাই মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করে।
সবলের হাতে দুর্বলের এই মৃত্যুযাত্রা কি কখনও থামবে না? শাসক আর শাসিতের ভিতর এই খাদ্য-খাদক সম্পর্কের অবসান কি কখনও হবে না? এ সব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের যেতে হবে সাহিত্যের দরবারে। ইতিহাসের পাতা ছুঁয়ে পৌঁছতে হবে স্বপ্নসন্ধানীদের লেখনীতে। হাজার বছর আগেকার চর্যাপদ-এর কথাই ধরা যাক। সেখানে কবি তো স্পষ্টত লিখছেন, আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী।
তবে কি হরিণের মতো মোরগের সুস্বাদু মাংসই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? শিকার হওয়ার জন্যই কি মোরগের জন্ম? না কি শিকারিকে সাজা দেওয়ার কেউ নেই? ইতিহাস বলছে, ছিল তো। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল-এ দেবী তো তাদের দুঃখ নিরসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও এর পিছনেও ছিল দেবীর নিজের মহিমা প্রচারের শর্ত। মনসামঙ্গল-এ দেবী মনসাও চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। কিন্তু বিষের জ্বালায় জ্বলেছিল লখিন্দর। তবে, দুনিয়ার প্রথম লেডি ডাক্তারের ভূমিকায় সে দিন অবতীর্ণ মনসা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যিনি মারেন, ফলাও করে বাঁচাবার দায়িত্বও তিনিই নিতে পারেন! তবে যত ক্ষণ না মালিকের স্বার্থসিদ্ধি হয়, তত ক্ষণ মোরগের যন্ত্রণাভোগ কিছুতেই কমবে না।
পাশাপাশি মনে পড়বে বঙ্কিমচন্দ্রের বিড়ালের কথা। যদিও সে কিছুতেই মুরগি হতে চায়নি। সাম্যবাদের টনটনে জ্ঞান তার ছিল। মনে রাখতে হবে তখন মালিক কমলাকান্ত ছিলেন আফিমখোর। সে কারণেই হয়তো বেঁচে গিয়েছিল সোশ্যালিস্ট বিড়াল। নতুবা বেঘোরে প্রাণ যেত তার। মনে হতে পারে তবে কি কোনও দিন বিচার পাবে না এই মোরগ, বিড়াল অথবা মুরগির দল? জন্মজন্মান্তর ধরে তারা কি কেবল ধনীর খাদ্য হয়েই জন্মাবে? কেবল সসের খবরই রাখবে? বাঁচার মন্ত্র কি তারা আওড়াবে না কোনও কালে? যুগে যুগে রাষ্ট্রের বেহুলারা কেবল মনসার উৎপাতই সয়ে যাবে? আর চাঁদ সওদাগর কি কেবল আপন বাণিজ্যতরী রক্ষা করতেই বলি দিয়ে যাবেন নিজ পরিবারের নিরীহ সদস্যদের?
এমন নানাবিধ প্রশ্নের ভিড়ে উত্তর খুঁজতে গিয়ে হতবাক হয়ে যাই। আর ঠিক তখনই পাল্টা অন্য একটি প্রশ্ন মনে উঠে আসে। মনে হয়, আর কবে অন্তত এক জন আস্তিক মুনি জন্মগ্রহণ করবেন, যিনি জনমেজয়ের নিধন যজ্ঞ থামিয়ে দিয়ে সর্পকুলকে বাঁচাবেন? এই স্বৈরতন্ত্রের অগ্নিকুণ্ডে আহুতি দেওয়া থেকে স্বজনদের রক্ষার দায়িত্বটুকু পালন করবেন?
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)