Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ধর্ম শেখায় ভালবাসা

এত দিন পরেও বিবেকানন্দকে আমরা ছুঁতেই পারলাম না। দেশ-বিদেশে মানবতা-বিরোধী বিভীষিকাময় ঘটনা ও দুষ্কর্মগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংঘটিত হয় কেন?

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:২৯
Share
Save

বিশ্বজিৎ রায়ের ‘এক স্বাদেশিক সন্ন্যাসী’ (১২-১) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, আজও আমরা ভাল পড়শি হয়ে উঠতে পেরেছি কি? এত দিন পরেও বিবেকানন্দকে আমরা ছুঁতেই পারলাম না। দেশ-বিদেশে মানবতা-বিরোধী বিভীষিকাময় ঘটনা ও দুষ্কর্মগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংঘটিত হয় কেন? তার অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে টিকে থাকার লড়াইয়ে ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করলে তার পরিণাম হয় ভয়াবহ।

বিবেকানন্দ ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী, তিনি ধর্মকে বেদান্তের আলোকে সুস্পষ্ট ভাবে ভারত তথা স্বদেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। ধর্ম যে একে অপরকে ভালবাসতে শেখায়, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ মুছে ফেলতে শেখায়, দেশের বৃহৎ স্বার্থের কাছে নিজের স্বার্থকে তুচ্ছ ভাবাতে শেখায়, তা যে আশামূলক এবং গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাঁচতে শেখায়, বিবেকানন্দ সে কথাই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। মানবিকতাই যে প্রকৃত অর্থে ধর্ম, তা বিবেকানন্দের জীবন থেকে স্পষ্টতই প্রতিভাত হয়। তথাকথিত হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ সকল ধর্মের মানুষ নির্বিশেষে যদি ধর্মের এই প্রকৃত স্বরূপটিকে অস্বীকার করে এবং গোষ্ঠীগত আচার-আচরণকেই ধর্মের স্বরূপ বলে মনে করে, তা হলে তা নিছকই সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন থাকে। এই ভুলটাই আকছার চতুর্দিকে ঘটে চলেছে এবং তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে মানুষকে। তাই ধর্মের প্রকৃত স্বরূপটি কী এবং রাজনৈতিক স্তরে ধর্মের গতিবিধি কত দূর হওয়া প্রয়োজন বা আদৌ প্রয়োজন কি না— তা বিশ্লেষণ করা বর্তমান সময়ে খুবই জরুরি।

মননশীল মানুষরা ভারতবাসীকে ধর্মের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করতে চাইলেও সে কাজে সম্পূর্ণ সফল হননি। আজ যদিও আর্থিক উন্নতি ও পেশাগত পার্থক্যের কারণে ভারতে জাতিভেদ প্রথা অনেকটাই দুর্বল, তবুও ভারতীয় রাজনীতিতে জাতিভেদ প্রথার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষার প্রসারের মধ্য দিয়ে জাতিভেদ প্রথার বিভেদমূলক অপশক্তি কিছুটা স্তিমিত হতে পারে। যদিও তথাকথিত শিক্ষিতরা অনেকেই লোকায়ত মানুষের তুলনায় বেশি করে বিভেদভাবনায় জড়িয়ে পড়েন। বিভেদকামীদের সক্রিয়তা সত্ত্বেও ভারতের অন্তর্নিহিত সর্বধর্মসহিষ্ণুতা রক্ষা পেয়েছে এবং বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক ভারতের ঐক্যকে এখনও সেই অর্থে বিঘ্নিত করতে পারেনি। এ বিষয়ে সরকারি সদিচ্ছা বাড়াতে হবে, সংবাদমাধ্যমগুলিকেও ন্যায়ের পথে চলতে হবে।

সংহতির পথে প্রধান বাধা যে তথাকথিত ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা— তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জানি না ব্যক্তিমানুষ কবে তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। তবে তার চেয়েও বড় বাধা আর্থিক বৈষম্য। প্রাদেশিক লড়াইয়ের অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে তাকালে আমরা প্রত্যেকেই বিষয়টি বুঝতে পারি। যান্ত্রিক এই বিশ্বে বিবেকানন্দের সেই চরম অনুভূতির স্তরে পৌঁছনো আশু প্রয়োজন।

রমজান আলি, মিঠাপুকুর, পূর্ব বর্ধমান

ভারতচিন্তা

বিশ্বজিৎ রায়ের ‘এক স্বাদেশিক সন্ন্যাসী’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে জানাই, স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নের ভারত হল, চেতনার আলোকে দীপ্ত মহান ভারত। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের নামে সংগঠন, যা মানুষকে পৌঁছে দেবে চেতনার আনন্দধামে। ধর্ম বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন বেদান্তের শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বমানবকে শিক্ষিত ও আলোকিত করে তোলার বিষয়টি।

পণ করেছিলেন যে, পশ্চিমের সামনে তিনি কিছুতেই ভারতকে খাটো হতে দেবেন না। ফলে, এমন অনেক কিছুর সপক্ষে তাঁকে যুক্তি সাজাতে হয়েছিল, যাকে ইংরেজিতে বলা যায় ‘ইনডিফেন্সিবল’। স্বামীজি দেখেছিলেন ইংরেজ আমলে রক্তাক্ত এবং অশ্রুময় দেশের ছবি। দেখেছিলেন কী ভাবে ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয়রা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়ছেন। সাধারণ মানুষের তখন দিশেহারা অবস্থা, না আছে পেটে খাদ্য, না আছে মাথার উপর ছাদ। পরিধানের বস্ত্রটিও শতচ্ছিন্ন এবং শিক্ষা সীমিত শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে। এই কারণে কেউ ব্রিটিশ শাসনের প্রশংসা করলে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করতেন স্বামীজি। পরিব্রাজক বিবেকানন্দ দেখেছিলেন দেশের সাধারণ মানুষের ভালবাসা, ধৈর্য এবং মুখ বুজে কাজ করার ক্ষমতা অতুলনীয়। স্বামীজির বক্তৃতাগুলিতে নতুন তত্ত্ব, নতুন ভাব, নতুন কর্মপদ্ধতির পরিচয় পেয়ে দেশের মনীষী ও হৃদয়বান ব্যক্তিরা বুঝলেন, নবযুগের সূচনা করার মতো অনুপম প্রতিভা ও অসামান্য হৃদয় নিয়ে সন্ন্যাসী তাঁর স্বদেশের কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসেছেন। তিনি ভারতসেবার জন্য আহ্বান জানিয়ে ছিলেন চরিত্রবান, হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান যুবকদের। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, যুবরাই দেশের ভবিষ্যৎ, তাঁরাই দেশকে গড়বেন।

প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি

এগিয়ে চলো

সোমা মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বিশ্বাসটাই যদি না থাকে?’ (১৪-১) প্রবন্ধ সম্পর্কে কয়েকটি কথা। গত বছরের অগস্টে কর্তব্যরত পড়ুয়া-চিকিৎসকের হত্যার পরে রাজ্য তথা দেশের মানুষ এক অস্থির সময় এবং অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চলেছে। শোক ও অসহায়তা, কৃতী সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যুর অসহনীয় বেদনা পরিণত হয়েছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জ্বলন্ত প্রতিবাদে। আন্দোলনের চাপে সরকার আংশিক দাবি মেনে নিলেও সকল দাবি তারা মানতে পারেনি।

মানুষের মধ্যে দীর্ঘ দিন জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়েছে। তাই কর্তব্যরত মহিলা পড়ুয়া-চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সারা রাজ্য তথা দেশ জুড়ে এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনজাগরণের জনজোয়ারে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল এ রাজ্যের কঙ্কালসার স্বাস্থ্যব্যবস্থা, চিকিৎসক হত্যার তদন্তপ্রক্রিয়া ও হুমকি-প্রথার বিরুদ্ধে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা পাওয়ার দাবিতে। সহজেই অনুমেয় যে, এই দাবিগুলি পূরণ করতে হলে এই সরকারের খোলনলচে বদলাতে হবে। ক্ষমতাপিপাসু বা ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি প্রশাসনিক ক্ষমতায় টিকে থাকাতে সমস্ত অপকর্মকে ছাড়তে পারা এই ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কার্যত অসম্ভব। তবু মনে হয়, হতাশ হওয়া বা বিশ্বাস হারানোর কিছু নেই। সরকার মুখে যা-ই বলুক না কেন, তারা কোনও ভাবেই সাধারণ মানুষের জনকল্যাণে প্রকৃত সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে না। তা আদায় করতে হয়, আর আদায় করতে গেলে বহু লড়াই, বহু আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

প্রসঙ্গত স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ রাজ্যেই যখন বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষার উন্নয়নের নামে প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ও পাশ-ফেল প্রথার বিলোপ ঘটিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে সুকুমার সেন, সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রতিভা বসু, সন্তোষকুমার মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, মানিক মুখোপাধ্যায়-সহ অগণিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রী তথা সমাজের সাধারণ মানুষকে দীর্ঘ সময় লড়তে হয়েছিল। পরবর্তী কালে বাম সরকার সেই লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়ে বাধ্য হয়েছিল প্রত্যাবর্তনে।

এই সমাজের অনেক বহুতলের শীর্ষেই চিল-শকুনেরা বাসা বেঁধে আছে, একটু সুযোগ পেলেই তারা ডানা ঝাপটায়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মেদিনীপুরের স্যালাইন-কেলেঙ্কারির বিষয়টিও জুনিয়র চিকিৎসকদের সে দিনের আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই অন্যায়গুলি ও হুমকি-প্রথা বন্ধ করতে গেলে মানুষের জীবনের অন্য সকল সমস্যাকে যুক্ত করে আরও অনেক লড়াই লড়তে হবে চিকিৎসক সমাজ-সহ আমজনতাকে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ ব্যতিরেকে ঠিক পথে আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে আরও অনেক পথ পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের সকলকে।

জয়দেব সরকার, দেওয়ানগঞ্জ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

vivekananda Idol

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}