E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ইতিহাসের দলিল

আজকের দিনে যখন চলচ্চিত্র প্রায়শই তাৎক্ষণিক বিনোদন বা নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য তৈরি সৃষ্টিকর্মে সীমাবদ্ধ, তখন শোলে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শিল্প কেবল সময়ের নয়, ইতিহাসেরও দলিল হতে পারে।

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:১৬

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্যের ‘একটা ছবি, একটা দেশ’ (৭-৯) প্রবন্ধটি পাঠে গভীর চিন্তার উদয় হয়েছে। শোলে (১৯৭৫)-কে নিছক একটি সফল চলচ্চিত্র না দেখে এটিকে ভারতের সাংস্কৃতিক মানসপটে এক বিরাট পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা যথার্থ। প্রবন্ধকার যথাযথ ভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, শোলে শুধু একটি সিনেমা ছিল না, এটি ছিল একটি ‘সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা’— যা ধর্ম, ভাষা বা অঞ্চলের বিভেদ অতিক্রম করে সমগ্র দেশকে এক অদম্য জাতীয়তাবোধ ও একাত্মতার অনুভূতিতে জড়িয়ে ধরেছিল। এর চরিত্র, সংলাপ ও গান জনমানসে এমন ভাবে মিশে গিয়েছিল যে, এটি সামাজিক বন্ধনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এটি সেই সময়ের ভারতীয় আত্মপরিচয়কে নতুন ভাবে গঠনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র শিল্পের দিক থেকেও একটি অনন্য মাইলফলক— প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, বাণিজ্যিক সাফল্য এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতির এক অনুপম সংমিশ্রণ। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পরের আজকের বাস্তবতায় এই আলোচনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যে সিনেমা একটি দেশকে ‘একটা ছবি’-তে রূপান্তরিত করেছিল, আজ সেই দেশটিই ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের নামে গভীর বিভাজন ও অসহিষ্ণুতার মুখোমুখি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি আমাদের সমাজের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দিচ্ছে। শোলে যে ভারতের চিত্রকল্প এঁকেছিল— সেখানে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ছিল প্রধান— আজ তা ক্রমশই বিভেদের রাজনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। আজকের দিনে যখন চলচ্চিত্র প্রায়শই তাৎক্ষণিক বিনোদন বা নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য তৈরি সৃষ্টিকর্মে সীমাবদ্ধ, তখন শোলে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শিল্প কেবল সময়ের নয়, ইতিহাসেরও দলিল হতে পারে। এই আলোচনা আমাদের মনে একটি জরুরি প্রশ্ন জাগ্রত করে— ভবিষ্যতের ভারতীয় সিনেমা কি আবারও সমাজকে একত্রিত করার, আমাদের মধ্যে মানববন্ধন শক্তিশালী করার ভাষা খুঁজে পাবে? না কি আমরা শোলে-র মতো সাংস্কৃতিক সংহতির উত্তরসূরি আর তৈরি করতে পারব না?

অলোক কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৫

পটভূমি

অগ্নি রায়ের “৫০ বছর ধরে ‘শোলে’র ফুলকি আর নিশি-অর্গান” (রবিবাসরীয়, ১৭-৮) প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। এক রাজনৈতিক অস্থির পরিবেশের পটভূমিকায় শোলে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট। গোটা দেশে তখন জরুরি অবস্থা চলছে। অতএব সেন্সর বোর্ড পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে তবেই শোলে-কে ছাড়পত্র দেবে। তাই এ ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং কিছু আমলাকে নিয়ে একটি প্রিভিউ শো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বয়ং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নাকি সেই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন। সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে কেউ কেউ শ্রীমতী গান্ধীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ছবিটিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হোক। কারও কারও মত ছিল শোলে-র মধ্যে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। অতএব ছবিটিকে কোনও মতেই মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মুক্তি অবশ্য মিলেছিল, কিন্তু প্রতিটি ব্যাপারে সেন্সর বোর্ডের কঠোর শাসনের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। ছবির মূল কাহিনিতে ছিল গব্বর সিং-কে ছবির শেষ দিকে হত্যা করেছিল ঠাকুর সাব। কিন্তু সেন্সর বোর্ড এই দৃশ্যে ছাড়পত্র দিল না। এর পর রমেশ সিপ্পিকে নতুন ভাবনা নিয়ে আসতে হয়। সেখানে দেখা যায় ঠাকুর গব্বর সিং-কে এমন ভাবে পা দিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছে যে, তাতে মৃত্যু অনিবার্য। তখন পুলিশ পরামর্শ দেয় আইন নিজের হাতে না তুলে নেওয়ার জন্য। কেননা শাস্তি দেওয়ার অধিকার আছে একমাত্র আইনের।

শোলে মুক্তি পাওয়ার পর গব্বরের বেশ কিছু সংলাপ জরুরি অবস্থার দোহাই দিয়ে কাগজে ছাপানোর কোনও অধিকার ছিল না। যেমন— “তেরা কেয়া হোগা, কালিয়া”, বা “জো ডর গয়া, সমঝো মর গয়া”— এই সমস্ত সংলাপ রাজনৈতিক সভায় কিংবা রাস্তাঘাটে ব্যবহৃত হতে থাকলে সরকার বিপদে পড়তে পারে। এমনই আরও অনেক সংলাপ ছিল যেগুলো ব্যবহার করলে সরকার-বিরোধী স্লোগান হয়ে উঠতে পারে— সে সব সংলাপ সেই সময় সেন্সর বোর্ডের নির্দেশে বাতিল করে দিতে হয়। এই ছবিতে গব্বরের একটি জনপ্রিয় সংলাপ মানুষের মুখে মুখে ঘুরত— “কিতনে আদমি থে?” মানুষ রসিকতা করে বলত— “এক ইন্দিরা থি।” এই সংলাপ বন্ধ করার জন্য পুলিশকেও নাকি উদ্যোগ করতে হয়েছিল।

রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

স্মৃতি অমলিন

শোলে ছবির ৫০ বছর উপলক্ষে অগ্নি রায়ের প্রবন্ধটি পড়তে গিয়ে এটা ভেবে আশ্চর্য লাগছিল যে, একটা সিনেমা কী ভাবে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। শোলে সম্পূর্ণ ভাবে একটি মুম্বই ঘরানার মূলধারার ছবি। এতে ‘ড্রামা, ইমোশন, অ্যাকশন’ সবই আছে। এই সব উপাদান অন্য হিট ছবিতেও থাকে। কিন্তু শোলে একটি মাইলস্টোন হয়ে উঠল কী ভাবে, তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রবন্ধকার দিয়েছেন। এক জন সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, শোলে-র চিত্রনাট্য ও সংলাপ অসাধারণ ছিল। বিশেষ ভাবে সংলাপ, যার ক্যাসেট আলাদা ভাবে বেরিয়েছিল এবং তা শুনে শুনে অনেক মানুষ প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। কিছু কিছু সংলাপ, যেমন— “কিতনে আদমি থে?” বা “সো জা, নহি তো গব্বর আ জায়েগা”— ৫০ বছর ধরে সাধারণ মানুষেরও মুখের ভাষা হয়ে উঠেছে। এমন আরও উদাহরণ আছে। চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করা যায় যে, রামগড় একটি কাল্পনিক গ্রাম হলেও তখনকার দিনে চম্বল এলাকায় এই ধরনের ডাকাতদের উৎপাত সত্যিই ছিল আর তাদের কাছে গ্রামবাসীরা ছিলেন অসহায়। তাই যখন এই ডাকাতদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিষয়টি এই সিনেমায় তুলে ধরা হল, সাধারণ মানুষের মনে হল এই ভাবেও রুখে দাঁড়ানো যায়। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য এই সিনেমার দৃশ্যপটও। সিনেমার একদম প্রথমেই ট্রেন থেকে ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ— অসাধারণ দৃশ্যায়ন। আর একটি দৃশ্য— রাধা এক-এক করে সব লন্ঠন নিবিয়ে দিচ্ছে রাতে আর মায়াময় জ্যোৎস্নার আলোর মধ্যে শোনা যাচ্ছে মাউথ অর্গানের সুর— এর থেকে রোম্যান্টিক দৃশ্য আর কী হতে পারে!

শোলে সিনেমার মাইলফলক হয়ে ওঠার আর একটি কারণ সিনেমার প্রতিটি দিকের যথাযথ ব্যবহার— ড্রামা, ইমোশন, অ্যাকশন, কমেডি— সব কিছুই যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই আছে। জোর করে দর্শকদের উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। প্রচলিত সমাজের প্রতি ব্যঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে জেলব্যবস্থা ও অপদার্থ জেলারের ভূমিকার মধ্যে দিয়ে। ছোটখাটো অনেক চরিত্র— সুরমা ভুপালি, এক সন্তানহারা পিতার ভূমিকায় এ কে হাঙ্গল— অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। যখন জয় বন্ধু বীরুর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে বাসন্তীর মাসির কাছে যাবে আর মাসি বিয়েতে অমত দেবে— বার বার সেই মজার দৃশ্যগুলির ঝলক দেখেও পুরনো হয় না।

বিভিন্ন সংলাপের মধ্যে দিয়ে যেমন প্রচলিত সমাজের প্রতি ব্যঙ্গ দেখানো হয়েছে, তেমনই এই সিনেমার মধ্যে দিয়ে নীতিবোধ ও উচিত-অনুচিতের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে, যেমন দু’পিঠ একই এমন একটি মুদ্রা দিয়ে টস করার বিষয়টি। আদতে নায়ক দু’জনই চোর হলেও তাদের নীতিবোধ প্রবল। বিশেষ করে জয়ের, টসে যে সব সময়েই জিতে যায়। কারণ, বীরু ভোলা প্রকৃতির হলেও জয় একটু অন্য ধরনের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যে নৈতিকতার বোধ হারিয়ে ফেলে না। তাই দ্বিতীয় নায়ক হয়েও জয়ের চরিত্রটি মানুষের মনে একটা চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয়। পঞ্চাশ বছর পরেও এই ছবির আকর্ষণ অমলিন।

দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৬

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

film Film industry

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy