আমাদের চার পাশে যা কিছু আছে, তাই নিয়ে আমাদের পরিবেশ। এই পরিবেশের ভাল-মন্দের উপর নির্ভর করছে আমাদের ভাল-মন্দ। অষ্টাদশ শতকে শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই পরিবেশ ভীষণ ভাবে দূষিত হতে শুরু করে। কলকারখানার বর্জ্য, ধোঁয়া ও নগরায়ণের জন্য ব্যাপক ভাবে গাছ কাটা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে থাকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে নানা রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ১৯৬৮ সালের ২০ মে রাষ্ট্রপুঞ্জের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কাছে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানায় সুইডেন সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১৬ জুন সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় পরিবেশ বিষয়ক মানব সম্মেলন। সম্মেলনটি পরিবেশ সচেতনতার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ এবং এ বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন হিসাবে স্বীকৃতি পায়। সদস্য রাষ্ট্রগুলি আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক করে মানুষকে সচেতন করার জন্য ৫ জুন দিনটিকে পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করা হবে ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হবে।
এর পর ১৯৭৩ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয় ‘শুধুমাত্র এক পৃথিবী’ স্লোগান নিয়ে। তার পর থেকে প্রতি বছর ওই দিনটি পালন করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন থিম নিয়ে। পরিবেশের সুরক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই দিনটি পালন করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হল পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের সমস্যাগুলি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ করা। অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার ও সে সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিও অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশ রক্ষার পদক্ষেপগুলির মধ্যে বর্তমানে বর্জ্য হ্রাস, বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জলের সাশ্রয়, পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার প্রভৃতি উদ্যোগ করা হয়। এ দেশেও এই দিনে বৃক্ষরোপণ করা, আবর্জনা পরিষ্কার, পরিবেশ বিষয়ক আলোচনা চক্রের আয়োজন, গান, কবিতা পাঠ, ছবি আঁকা-সহ নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। প্রতি বছর যে ভাবে উষ্ণতা বাড়ছে, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ভূমিধস-সহ নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে, তাতে অবিলম্বে মানুষ সচেতন না হলে সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। পরিবেশকে ভাল রাখতে গেলে আমাদের সর্বপ্রথম পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহারের উপর বেশি জোর দিতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জলের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনকেও পরিবেশবান্ধব বাড়ি, গাড়ি ও নগরপরিকল্পনায় উদ্যোগী হতে হবে। কাগজের ব্যবহার কমিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে। কারণ, পরিবেশ সুরক্ষায় গাছের কোনও বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন রুখতে নানা রকম আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি মানুষের ভাবনা-চিন্তার উপর পরিবেশের সুরক্ষা নির্ভর করছে অনেকটাই।
কোনও একটি বিশেষ দিন পালন করলেই পরিবেশ রক্ষা পাবে না। কেননা এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পরিবেশের ভাল থাকার উপর যে-হেতু আমাদের ভাল থাকাও নির্ভর করছে, তাই সকলকেই পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে এবং পরিবেশের উন্নতির কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
একটি গণ্ডূষ জল
বাস্তুতন্ত্রে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখি তো বটেই, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গের অংশীদারিও অস্বীকার করা যায় না। তেমনই এক উপকারী কীট কেঁচো আর সামাজিক পতঙ্গ হল মৌমাছি। অন্য দিকে, পাখিদের খোলামেলা, বন্ধনহীন জীবনযাত্রা আর বহুবিচিত্র কলকাকলি পরিবেশকে করে ছন্দোময়, সরস ও প্রাণবন্ত। রঙের চাকচিক্য, সুবিন্যস্ত পালকের নান্দনিক সৌন্দর্য এবং সুললিত সুরের জাদু মানুষের মনকে মুগ্ধ করে। পরিযায়ী পাখিরা প্রকৃতির আর এক অপার বিস্ময়! তারা ক্ষণস্থায়ী শীতের অতিথি। ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। তীব্র ঠান্ডার প্রকোপ এড়াতে দল বেঁধে এ দেশে আসে। সময় বুঝে ফিরেও যায়। অন্য দিকে, শীতের মরসুমে স্বচ্ছন্দে থাকলেও গরমের দিনে দেশীয় পাখিদের বুঝি যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। গরমে হাঁসফাঁস করে। মাঠ-ঘাট, জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় তৃষ্ণার্ত পাখিরা হয় দিশাহারা। অট্টালিকা পরিবেষ্টিত শহরাঞ্চলে পাখিদের অবস্থা আরও করুণ! বুকফাটা তৃষ্ণায় বাড়ির আনাচে-কানাচে পরিত্যক্ত খটখটে নীরস পাত্রগুলির চার পাশে অথবা জলের ট্যাপের কাছে গিয়ে এক বিন্দু জলের জন্য বিস্তর আকুলিবিকুলি করে।
দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ‘নাই রস নাই...’ (২৩-৫) শীর্ষক মর্মস্পর্শী ছবিটি তার বাস্তবিক প্রমাণ। অথচ, দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততায় অনেক সময় আমরা এই দৃশ্য দেখার চেষ্টাই করি না অথবা দেখেও তা নিয়ে ভাবি না। সনির্বন্ধ অনুরোধ, গরমের দিনগুলিতে আমরা যদি বাড়ি সংলগ্ন খোলা জায়গা কিংবা ছাদে মাটির গামলায় একটু করে জল রাখি, তা হলে অসহায় তৃষ্ণার্ত পাখিগুলি প্রাণ পায়। পরিতৃপ্ত পাখিদের প্রাণখোলা ডাকে তপ্ত ঝলসানো দ্বিপ্রহরও কর্মক্লান্ত মানুষের কাছে হয়ে উঠতে পারে আরও স্নিগ্ধ-মধুময়।
ভানুপ্রসাদ ভৌমিক, হিমনগর, হুগলি
বিকাশেই বিনাশ?
যুধাজিৎ দাশগুপ্তের ‘যে জীবন ফড়িঙের’ (৮-৬) শীর্ষক প্রবন্ধ এবং ওই একই দিনে কুন্তক চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন ‘মানুষের আলোয় বিপদে দিশাহারা জোনাকি পোকা’ ভাবতে বাধ্য করে। জীবজন্তুর সঙ্গে প্রতি বছর অসংখ্য কীটপতঙ্গ এবং জলজ প্রাণীর অবলুপ্তি ঘটছে দ্রুত গতিতে। গ্রামের দিকে গাছপালা ঘেরা জায়গায় প্রজাপতিদের দেখা গেলেও ফড়িং এবং গঙ্গাফড়িং প্রায় দেখাই যায় না। ছোটবেলায় গরমের দুপুরে রঙিন কাচপোকা, বর্ষায় ভেজা ঘাসে লুকিয়ে থাকা লাল ভেলভেট পোকা আজ লেখকদের গল্প-কবিতায় স্থান পেয়েছে। মরসুমি ফুল দিয়ে সাজানো বাগান কৃত্রিম বলে মনে হয়। ছোটবেলায় দেখা গুবরে পোকার নিরন্তর গোবরের ঢেলা গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া আজও মনে সজীব। বাবুই পাখির বাসায় জোনাকির আলো আমি দেখেছি গ্রামে। আজ কি আর দেখা যায় সে দৃশ্য? অন্ধকার রাতে পুকুর পাড়ে জোনাকির মেলায় চার ধার আলোকিত হয়ে থাকত। ধীরে ধীরে এই সব কীটপতঙ্গ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে এবং যতটুকু বাকি আছে সেটুকুও বিলুপ্তির পথে। পৃথিবীর বুকে যাদের বিচরণ অবাধ হওয়া উচিত, তাদের বন্দি করে খাঁচায় পুরে, শিবির করে কত দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে জানি না। অবলুপ্তির কারণগুলি অনুধাবন করলে দেখা যাবে বন উজাড়, বিষাক্ত বর্জ্য জমা, আবহাওয়ায় পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি দায়ী। অর্থাৎ, বিকাশই বিনাশের কারণ। বিকাশ কি পরিবেশকল্যাণমূলক হতে পারে না?
শ্রীময় ঘোষ, জামশেদপুর
অবাধ প্লাস্টিক
প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র রমরম করে চলছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। খোলা বাজারে এখনও অনেক দোকানদার অবাধে প্লাস্টিকের ব্যাগ, জিনিসপত্র বিক্রি করে যাচ্ছেন। বার বার পুরসভা, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। ছোট দোকান থেকে শুরু করে বড় দোকান, মাছের বাজার থেকে শুরু করে মাংসের দোকান সর্বত্র নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগ বহাল তবিয়তে রয়েছে। আগামী দিনে পুরসভা তথা রাজ্য সরকারকে আরও কড়া পদক্ষেপ করতে হবে। প্রত্যেকটি পুরসভায় একটি করে দল গঠন করতে হবে, যাঁরা সমস্ত দোকান-বাজারে নজরদারি চালিয়ে ক্যারিব্যাগ যাঁরা ব্যবহার করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবেন।
সুদীপ্ত দে, কলকাতা-১০২
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)