‘মর্মান্তিক’ (১৪-৬) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। ভারতে অসামরিক বিমান পরিবহণের ইতিহাসে ভয়াবহ দুর্ঘটনার অন্যতম নজির হয়ে থাকবে আমদাবাদের বিমান-দুর্ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল। ভেঙে পড়ার আগে বিমানটি সর্বোচ্চ যে গতিতে পৌঁছতে পেরেছিল, তা স্বাভাবিক নয়। ওই সময়ে বিমানের গতি আরও অনেক বেশি হওয়ায় কথা, কোনও কারণে বিমানের ইঞ্জিন শক্তি হারিয়ে ফেলে। তার ফলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমদাবাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটি ছিল বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার। এই মডেলটির ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটি’ বার বার আলোচনায় উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে একাধিক বার ড্রিমলাইনার-এর লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তার পরই বিশ্বব্যাপী বোয়িংয়ের ৭৮৭-এর বহরকে কিছু দিন বসিয়ে দিয়েছিল আমেরিকান বেসরকারি বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফএএ।
ভারতে বিমান-দুর্ঘটনা আগেও হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার বহু বিমানও একাধিক বার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। ২০২১ সালে এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর মনে হয়েছিল, এয়ার ইন্ডিয়ার হয়তো সুদিন ফিরতে চলেছে। কিন্তু সংস্থার লোগো বা মোড়ক বদলালেই যে খোলনলচে বদলে যায় না, সেটা এয়ার ইন্ডিয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে যাত্রী-সংখ্যার নিরিখে ভারত বিমান পরিবহণ বাজারে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে। তার উপর ‘উড়ান’ প্রকল্পের ফলে আঞ্চলিক স্তরে বিমানবন্দরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে উড়ানের সংখ্যাও। কিন্তু এই প্রসারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাত্রী-সুরক্ষা উন্নত হয়নি। তা ছাড়া ভারতে বিমানচালক ও ট্র্যাফিক কন্ট্রোল অফিসারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আর্থিক সমস্যার মোকাবিলায় প্রযুক্তি ও যাত্রী-সুরক্ষার ক্ষেত্রে সমঝোতা করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার কারণ জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে। পাখির ধাক্কা না ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় এই বিপত্তি, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। দুর্ঘটনায় নাশকতা যোগ রয়েছে কি না, তারও তদন্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার আশ্বাস দিয়েছে, তদন্তে ত্রুটি থাকবে না। কিন্তু প্রয়োজন দ্রুত তদন্ত শেষ করে, দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। কারণ ভারতে শুধুমাত্র তদন্তের আবর্তে দীর্ঘ দিন থাকার ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই দোষীরা পার পেয়ে যায় এবং তদন্ত কালের গর্ভে ধামাচাপা পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও যাতে তা না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন কেন্দ্রীয় সরকারের।
রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
দায়ী কারা
গত ১২ জুন আমদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং বিমান-দুর্ঘটনায় প্রায় তিনশো মানুষের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। দুর্ঘটনার কারণ অবশ্যই উদ্ধার হওয়া ব্ল্যাকবক্স এবং তদন্তের রিপোর্টে প্রকাশ পাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কথা অস্বীকার করা যায় না। বিমান আকাশে ডানা মেলার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ল, এই ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এত বড় একটি বিমান সংস্থা, দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে তার বিমান লন্ডন পাড়ি দিচ্ছে। অথচ, আকাশে ওড়ার আগে বিমানের খুঁটিনাটি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা হবে না? ড্রিমলাইনার-এর যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গলদ আছে, বিভিন্ন আলোচনা থেকে সেই তত্ত্ব উঠে আসছে। হয়তো আগে থেকেই এই বিমানেও যন্ত্রাংশে গুরুতর ত্রুটি ছিল, যা বিমান আকাশে ওড়ার আগে ভাল করে পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে যেত। রক্ষা পেতেন যাত্রী, ডাক্তারি পড়ুয়া, ও সাধারণ মানুষরা।
শোনা যায়, বর্তমানে বেসরকারি বিমান পরিষেবা নাকি শহরের বাসের মতো অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। মানুষের জীবন-মরণের যেখানে প্রশ্ন, সেখানে এই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থাকবে কেন? ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে তো তারা বিন্দুমাত্র পিছিয়ে থাকে না। যখন-তখন ভাড়া বাড়ানো হবে, অথচ যাত্রী-সুরক্ষা ও যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে কোনও নজর দেওয়া হবে না? অন্য দিকে, বেসরকারি বিমান পরিবহণ বলে কি সরকারের কোনও দায়ই নেই? সরকার তো বহু কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থা থেকে। তা হলে তারাই বা কেন বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থার উপর নজরদারি চালাবে না?
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
লাভের কড়ি
সম্পাদকীয় ‘মর্মান্তিক’ প্রসঙ্গে দু’-একটি প্রাসঙ্গিক কথা। ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর টাটা গোষ্ঠী ১৮ হাজার কোটি টাকায় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ বিমান সংস্থাটি কিনে নেয়। খবরটি পেয়ে দেশের বহু মানুষ স্বস্তি পেয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের ধারণা, ‘টাটা’ মানে তাদের ম্যানেজমেন্ট ও পরিষেবা বিশ্বমানের। আমদাবাদ বিমানবন্দর থেকে বিমান টেক অফের পাঁচ মিনিটের মধ্যে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে গেছে, তা নাকি ‘দুর্ঘটনা’, যেটা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে। সম্পাদকীয়তে যথার্থ ভাবে দাবি করা হয়েছে, তদন্তে যদি উঠে আসে যে বিমান উড়ে যাওয়ার আগে সব কিছু বারংবার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখার কথা যা সংশ্লিষ্ট বিমানটির ক্ষেত্রে হয়নি, তবে যাদের গাফিলতিতে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, তাদের উপযুক্ত শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে— আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিমান-‘দুর্ঘটনা’র যে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার কথা, সেই বিষয়টিকে নিয়মমাফিক ধামাচাপা দেওয়া হতে পারে! এবং এটা কারও অজানা নয় যে, প্রায় সমস্ত বেসরকারি সংস্থাতেই কর্মী অপ্রতুল। অধিকাংশ সময়েই তাঁদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যা অবশ্যই আইএলও-র নিয়মবিরুদ্ধ।
দুঃখের কথা, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরই বিশ্বাস তৈরি হয়ে গিয়েছে— পরিষেবা যখন সরকারি থেকে বেসরকারি হাতে যায়, তখন সেই পরিষেবা ম্যাজিকের মতো উন্নত, সুরক্ষিত হয়ে যায়। এই ভ্রান্ত ভাবনাও ভেঙে দিল আমদাবাদে বিমান-বিপর্যয়। এটা সত্য যে, সাধারণ ভাবে বেসরকারি সংস্থা চিরকাল দায়বদ্ধ লাভের কড়ি দ্রুত ঘরে তুলতে। মুনাফার লোভ যখন মানুষের জীবনের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে— তখন বিমান নির্মাণ, মেরামতি, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নির্মম ভাবে অবহেলিত হবেই।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
ধ্বংসের পথ
আমদাবাদের ভয়াবহ বিমান-দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথের পথে কপ্টার ভেঙে মৃত্যু ঘটল ৭ জনের। হিমালয়ের ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলে নতুন রাস্তা বানিয়ে বিখ্যাত চার ধাম যুক্ত করা হয়েছে। তড়িঘড়ি পুণ্য অর্জনের তাড়নায় পকেটে টাকা থাকলেই ৯-১০ ঘণ্টার হাঁটাপথ কয়েক মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। কোনও রকম পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই কপ্টার যাত্রার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ২০১৩ সালের ভয়াবহ কেদারনাথ বিপর্যয়, তার পরের জোশীমঠ বিপর্যয়ের কথা বোধ হয় আমরা ভুলে গিয়েছি। সম্প্রতি হিমালয়ের বিখ্যাত হেমকুণ্ড সাহিব এবং ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস-এর হাঁটা পথে রোপওয়ে সংযোগের পরিকল্পনায় অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। প্রস্তাব উঠেছে রুদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত ট্রেন সংযোগের কথাও। কিন্তু এই বিপুল চাপ কি হিমালয়ের ওই অঞ্চল নিতে পারবে? ১৯৮৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হিমালয়ের বেশ কিছু অঞ্চলে পদযাত্রার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন এত সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবাই যেত না। যাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজতে গিয়ে আমরা হিমালয়ের এই অঞ্চলের ধ্বংসকেই ত্বরান্বিত করছি না তো?
মানস কুমার সেনগুপ্ত, কলকাতা-৭৪
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)