‘শিক্ষক দারোগারূপে সংস্থিত?’ (৭-৪) প্রবন্ধে শৈবাল বসু ঠিকই বলেছেন যে, আজ আর শিক্ষার মূল লক্ষ্য মানুষ গড়া নয়। পড়াশোনা আজ শুধু পরীক্ষাকেন্দ্রিক, একশো শতাংশে পৌঁছনোর জীবনপণ লড়াই। আছে তথাকথিত ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তির অসম প্রতিযোগিতা। ‘মার্কামারা কোর্স’ শেষে বিরাট প্যাকেজের চাকরির হাতছানি যে বড় সীমিত আজ! কাজেই প্রত্যাশার পারদ ছোঁয়ার চাপ মারাত্মক। সেখানে ব্যর্থ হলে গ্রাস করে হতাশার গ্লানি। জীবনের একমাত্র ‘মোক্ষ’ থেকে বঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রণায় জীবন হয় দুর্বিষহ। অবশ্য সাধারণ ভাতকাপড়টুকু জোগাড়ের রাস্তাও আজ দুর্গম। বাড়ছে নিত্যনতুন ‘ডিজিটাল অসদুপায়’ অবলম্বনের নানা ফন্দিফিকির। ছাত্র, এমনকি শিক্ষকদের একাংশের মধ্যেও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ধৈর্য বা সংযম রক্ষা করা বিষম দায়। নিছক সিলেবাসে আটকে রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের উদারতা বা সহিষ্ণুতার পাঠ দেওয়া সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক পরিবেশের কারণে তাদের মধ্যে আসছে মানসিক অবসাদ। ঘটছে নানা হিংস্র ঘটনা।
তবে আশার কথা, শিক্ষকদের একাংশের সঙ্গে আজও ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের গভীর সংযোগ তৈরি হয়। আজও ছাত্র-ছাত্রীদের আনন্দপূর্ণ কণ্ঠস্বর ও কলতান শুনতে শুনতে সেই সব শিক্ষক-শিক্ষিকার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। “এই আনন্দ, এ যে নিখিল মানবচিত্ত থেকে বিনিঃসৃত অমৃত-উৎসের একটি ধারা।” আজও প্রিয় শিক্ষকের বদলি আটকাতে ছাত্র-ছাত্রীরা সব রকম চেষ্টা করে চলে। শিক্ষক-শিক্ষিকার অবসরকালীন সম্পর্ক ছিন্নতায় ছাত্রমন আকুল হয়, বিদায়-বিষণ্ণতায় হয় ব্যাকুল।
মনে রাখতে হবে, বিদ্যার সম্পদ যিনি পেয়েছেন তাঁর নিজেরই দায়িত্ব নিঃস্বার্থ ভাবে তা দান করা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, তাঁরাই শিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত যাঁরা ধৈর্যবান, ছাত্রদের প্রতি স্নেহ যাঁদের স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গত শতাব্দীতেই তিনি বলে গিয়েছেন, “যাদের সঙ্গে তাঁদের ব্যবহার, ক্ষমতায় তারা তাঁদের সমকক্ষ নয়। তাদের প্রতি সামান্য কারণে অসহিষ্ণু হওয়া এবং বিদ্রূপ করা অপমান করা শাস্তি দেওয়া অনায়াসেই সম্ভব।... রাষ্ট্রতন্ত্রেই কী আর শিক্ষাতন্ত্রেই কী। কঠোর শাসন-নীতি শাসয়িতারই অযোগ্যতার প্রমাণ।”
সুদেব মাল, তিসা, হুগলি
হিংসার রাজত্বে
বিগত কয়েকটি দশক ধরে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমাবনতির কারণ খুঁজতে প্রচেষ্টা করতে দেখা গেল শৈবাল বসুকে, ‘শিক্ষক দারোগারূপে সংস্থিত?’ প্রবন্ধে। স্বল্প-পরিসরের আলোচনায় এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসাবে বেশ কিছু ইতিবাচক পরামর্শও দিয়েছেন। তাঁর মতামতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেও বলতে চাই, বোধ হয় আরও কিছু কারণ বা সমস্যার উপর নজর দিতে হবে, যার সমাধানের অনেকটাই শিক্ষকদের হাতের বাইরে। তবু নিরাময় খুঁজতে গেলে পীড়ার কারণগুলি সম্যক রূপে খতিয়ে দেখা চাই। তা না হলে অন্ধকারে তরোয়াল চালিয়ে শত্রু নিকাশ করা মুশকিল।
প্রবন্ধের শুরুতে উঠে এসেছে শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের মধ্যে বিশ্বাসহীনতার এক বিমর্ষ ছবি, যেখানে রাজ্যে পরীক্ষাকেন্দ্রে ছাত্রদের প্রবেশ করার সময় মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তাদের তল্লাশ করা হয়েছে। একটি এলাকায় তল্লাশি নাকি আপত্তিজনক স্তরে পৌঁছয়। তার থেকে উদ্ভূত হয় শোধ তোলার প্রবণতা, শিক্ষকদের উপর আক্রমণ চালিয়ে দেয় ছাত্রেরা। লজ্জার ছবি ছড়িয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যমে। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তটি যাঁরা নিয়েছিলেন, তাঁরা তো কিছু অপরিণতমনস্ক অল্পবয়সি অশিক্ষিত নন। তাঁরা শিক্ষক। ধরে নিতেই হবে পরিপ্রেক্ষিত তাঁদের বাধ্য করেছিল একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এবং সেটা কোনও এক-আধটি তাৎক্ষণিক ঘটনার ফল ছিল না।
এখন সারা বিশ্ব জুড়ে হিংসার রাজপাট। সেই হিংসা চুঁইয়ে নামে মানুষের মনে, অবলীলায় সমাজ থেকে ঢুকে পড়ে পরিবারের চার দেওয়ালের মধ্যে, সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে। তার উপরে রয়েছে কাজের সুযোগের অপ্রতুলতা। জীবিকার্জনের জন্য কিছু পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট কাজে লাগতে পারে। যারা তা সহজে পাচ্ছে না, তাদের মধ্যে অকৃতকার্য হওয়ার মূল কারণ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে আক্রোশ, হিংসা বাড়তে পারে। সেখানে চরমপন্থার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।
মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রসঙ্গে আসে বিমানযাত্রার পূর্বে প্রয়োজনীয় রুটিন তল্লাশি পর্ব। সেখানকার নিরাপত্তায় ফাটল থাকলে অনেক মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে, তাই কারও আপত্তি করার কিছু থাকে না। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে ফাঁকির কুফলগুলি অনেক সময়ই ছাত্রদের চোখে পড়ে না। তাই কি এত আপত্তি?
একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই আলোচনায় সে ভাবে স্পষ্ট করে বোঝা যায়নি। তা হল, সব জায়গাতেই সব ছাত্র ছুরি-ছোরা নিয়ে বসে নকল করে না। তেমনই শিক্ষকেরাও সকলে ছাত্রদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রকাশে নিজের ভিতরে গভীর আনন্দ লাভ করেন, তা কখনওই নয়। যে কোনও কারণেই হোক, উগ্র প্রকৃতির পড়ুয়া আগেও ছিল, এখনও আছে। ঠিক তেমনই শিক্ষকদের ভিতরেও একটু আগ্রাসী মনোভাবের মানুষ চিরকালই ছিলেন এবং তাঁরা কিন্তু এখনও আছেন।
অর্থাৎ, মানসিক ভাবে আলাদা মনোযোগ দাবি করে, একটি শ্রেণিকক্ষের পড়ুয়াদের মধ্যে এমন দু’-এক জন থাকা অস্বাভাবিক নয়। নিয়মিত ভাবে পরীক্ষা চালিয়ে তাদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ক্লাসেই বিশেষ পর্যবেক্ষণের আওতায় রেখেও দেখা যেতে পারে।
তাই আমার মত, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই শিক্ষক ও পড়ুয়া, উভয়েরই নিয়মিত মন-পরীক্ষা ও কোনও সমস্যা থাকলে সমাধানের যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণের দিকটি অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে কেবল ধমক-ধামকের রাস্তায় চললে গোড়া বাদ দিয়ে আগায় জল দেওয়া হবে।
বিশ্বনাথ পাকড়াশী, শ্রীরামপুর, হুগলি
মানবিক হোন
চাকরিহারা শিক্ষকদের বিশেষ কর্মসূচি উপলক্ষে কলকাতার কসবা শিক্ষাভবনের সামনে যে ঘটনা ঘটেছিল, তা নিন্দনীয়। ডেপুটেশন দিতে এসে বাধাপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করলে তাঁদের উপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ, পদাঘাত, ঘুষিচালনা করতে শুরু করে পুলিশ। অনেকটা একই ছবি দেখা গেল সম্প্রতি বিকাশ ভবনের সামনেও, শিক্ষকদের বিক্ষোভে।
শিক্ষকেরা যদি কোনও ভুলও করে থাকেন, তবুও তাঁদের মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশকে সংযমী হতে হত। এই মুহূর্তে আমাদের প্রত্যেকেরই চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করা দরকার। মাত্র তিন মাস বাদে পুনরায় চাকরির পরীক্ষার জন্য বসা কি খুব সহজ? তাও এত দিন কেটে যাওয়ার পর! চাকরির পরীক্ষায় বসলেই যে আবার উত্তীর্ণ হওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? যে সব পুলিশকর্মী আজ শিক্ষকদের অন্যায় এবং দৃষ্টিকটু ভাবে মারছেন, ভবিষ্যতে তাঁরাও যে এই অবস্থার মধ্যে পড়বেন না তার কোনও নিশ্চয়তা আছে কি?
এই সব ঘটনা দেখে এবং পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি পঙ্ক্তি মনে পড়ে গিয়েছিল। তিনি লিখেছেন, “পরের অস্ত্র কাড়িয়া লইলে নিজের অস্ত্র নির্ভয়ে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠে— এইখানেই মানুষের পতন।” এখানে তো এই বিক্ষোভরত শিক্ষকদের অস্ত্রও কেড়ে নেওয়া হয়নি। তাঁরা বরাবরই নিরস্ত্র। এ আর নতুন কী কথা। কিন্তু কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের চাকরিটা। তাঁদের উপর বীরত্ব ফলাবার এই কি সময়?
তবে সময় এসেছে। সকল শিক্ষিত, সুস্থ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা এই অতীব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠুন।
অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)