রোচনা মজুমদারের ‘আধুনিক ব্যক্তিসত্তার উদ্ভাস’ (২-৮) শীর্ষক প্রবন্ধের সূচনায় আমাদের বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবে উপস্থিত। তবে, প্রবন্ধকার সত্যজিৎ রায়ের নিজের শহরে তাঁর সামগ্রিক চলচ্চিত্র নিয়ে নিবিড় পরিচয় থাকা মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমছে বলে জানালেও তার কারণ সম্পর্কে বিশদ উল্লেখ করেননি। সত্যজিৎ রায়ের কাজের প্রতি আমাদের সমাজের বিশেষ করে যুবসমাজের ধারণা অতি স্বল্প, কিন্তু তা নিয়ে শুধু হাহুতাশ কোনও উল্লেখযোগ্য সমাধানের দিকে ধাবিত করে না। সংস্কৃতিমান বাঙালির এই অবস্থা কেন, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ অবশ্যই শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের অভাব। মানুষ যখন নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ে ক্লান্ত, বিক্ষত তখন এ-হেন সুস্থ রুচিসম্পন্ন ঋদ্ধ আলোচনা মানুষের স্বাভাবিক চেতনার বলয়ে প্রবেশাধিকার পায় না। আজকাল আইটি সেক্টরের সাধারণ কর্মীকে দিনে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টার উপর কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, ছুটির দিনেও তাঁরা ব্যস্ত ল্যাপটপ-এর সামনে। বণ্টন বৈষম্য এবং আদর্শহীন রাজনীতি সরকারের হাতে দায়িত্বের বদলে ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে যা সমাজের সংস্কৃতিসম্পন্ন চেতনার উদয় ও সুস্থ রুচিশীল জীবনের স্রোতকে ক্রমশ ব্যাহত করছে। এর সমাধান হল যথাযথ শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন ও উপযুক্ত কর্মসংস্থান।
আর একটি বিষয় রয়েছে, যা সম্পর্কে বলার প্রয়োজন বোধ করছি। প্রবন্ধকার অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে সত্যজিৎ রায় নির্মিত চলচ্চিত্রগুলিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন এবং প্রত্যেকটি পর্যায়ের একটা করে তুলনামূলক ব্যাখ্যা যোগ করেছেন। তিনি গুপী গাইন বাঘা বাইনকে একটি অতি উচ্চমার্গের ফ্যান্টাসি মিউজ়িক্যাল বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই সিনেমাটি সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। গুপী গাইন বাঘা বাইন একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তাবাহী সিনেমা যা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নির্মিত। সিনেমায় খুব সুচারু ভাবে আগ্রাসী যুদ্ধোন্মত্ততার বিরোধিতার অনুরণন ঘটেছে বিশেষ করে ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল’ গানটির মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, এই প্রবন্ধে হীরক রাজার দেশে সিনেমার আলোচনা নেই দেখে দুঃখ হল। হীরক রাজার দেশে ভারতে তৈরি একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ছবি। জরুরি অবস্থার পরবর্তী সময়েও এমন ধারার স্বৈরতন্ত্র বিরোধী ছবি যুগেই যুগেই হয়েছে, সেই ধারা এখনও অব্যাহত, বলা যেতে পারে ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র বুঝতে গেলে তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস সম্পর্কে সুবিদিত হতে গেলে এই চলচ্চিত্রের স্পষ্ট আলোচনা অত্যন্ত জরুরি।
প্রয়াস মজুমদার, কলকাতা-৩৪
সমস্যা আরও
‘অসংবেদনশীল’ (২৮-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে এই চিঠি। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর স্বামীনাথন জানকীরামন বলেছেন, সহানুভূতিশীল মনোভাবের অভাবই হল ব্যাঙ্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা। গ্রাহকদের প্রতি ব্যাঙ্ককর্মীদের সহানুভূতিশীল মনোভাবের অভাব অবশ্যই ব্যাঙ্ক শিল্পের একটি সমস্যা, তবে এটিকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা কতখানি যুক্তিযুক্ত? ব্যাঙ্ক শিল্পে এর চেয়েও বড় সমস্যা হল, ব্যাঙ্কে অনুৎপাদক সম্পদ তথা এনপিএ-র বৃদ্ধি এবং অনাদায়ি ঋণ আদায়কে যথোপযুক্ত গুরুত্ব না দিয়ে খাতা থেকে সেগুলিকে মুছে দেওয়া বা মকুব করে দেওয়া। এ হল ব্যাঙ্কে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চিত অর্থের নয়ছয়। বড় সমস্যা হল, ব্যাঙ্কে স্থায়ী কাজে স্থায়ী-কর্মী নিয়োগ না করে অস্থায়ী-কর্মী নিয়োগ করে সম-কাজে সম-বেতনের নীতির খেলাপ। বড় সমস্যা হল, ব্যাঙ্ক নিজে এই সব কর্মী নিয়োগ না করে ঠিকাদারদের মাধ্যমে নিয়োগ করছে, যে ঠিকাদাররা তাদের কর্মচারীদের নানা ভাবে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা-সহ অনিয়মের পর অনিয়ম করে চললেও তাদের ব্যবসা অবাধে চলতে থাকে। এবং বড় সমস্যা হল, গ্রাহকদের পরিষেবা শুল্ক তথা সার্ভিস চার্জ-এর ক্ষেত্র এবং পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যাঙ্কের দূরত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি করা। এমনই আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আছে যা সহানুভূতিশীল মনোভাবের অভাবের সমস্যার আগে ঠাঁই পেতে পারে।
তবে এটা ঠিকই যে, সহানুভূতিশীল মনোভাবের অভাবের ফলে ব্যাঙ্ককর্মী এবং গ্রাহকদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ঈপ্সিত সাফল্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্ষতিগ্রস্ত করে ব্যাঙ্কের সাধারণ গ্রাহকদের স্বার্থকেও। এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, এখানে চাকরি যাওয়ার ভয় নেই বলে এমন দুর্ব্যবহার। এটাই বা কতখানি যুক্তিগ্রাহ্য? মানুষে মানুষে সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার না রাখা বা দুর্ব্যবহার করা একটা সামাজিক ব্যাধি যা এই সমাজে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ব্যাঙ্ক পরিষেবা নয়, রেল পরিষেবা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ক্ষেত্র, সরকারি ক্ষেত্র সর্বত্রই এটা একটা ক্রমবর্ধমান সমস্যা। বর্তমান পরিকাঠামোয় এই সব সমস্যা সমাধানের কিছু পথ বাতলে দেওয়া থাকলেও এগুলো বিভিন্ন কারণে সব সময় কার্যকর হয় না। এটা ঠিকই যে, প্রচলিত আইনের মধ্যেই এর সমাধান লুকিয়ে রয়েছে। যেখানে চাই নজরদারি এবং ইতিবাচক উদ্যোগ। এ নিয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ বা নজরদারির যে অভাব তার অন্যতম কারণ মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মী সঙ্কোচনের নীতিকে আঁকড়ে থাকা। নীতি প্রণয়নকারীরা অর্থাগমকে যতটা গুরুত্ব দেন এই বিষয়গুলিকে ততটা গুরুত্ব দেন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া কাজ বাড়ছে, লোক কমছে— এটা ঘটনা। এটাকে স্রেফ অজুহাত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটাকেও বিচারের মধ্যে রাখতে হবে। আর্থসামাজিক অবস্থানের সাপেক্ষেও যে আচরণের বৈষম্য ঘটে তা অনস্বীকার্য। এটা আমাদের সামাজিক কাঠামোর এক গুরুতর অন্তর্নিহিত সমস্যা। এই কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে এই মনোভাবকে পাল্টানো খুব সহজ বিষয় নয়।
তবে আরবিআই-এর ডেপুটি গভর্নর যে কথাটি বলেছেন তার উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্ন। তিনি আসলে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের পরিপ্রেক্ষিতে এমন সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
১৯১৩ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল— ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণের আগে পর্যন্ত— এ দেশের ২১৩২টি বেসরকারি ব্যাঙ্কে লাল বাতি জ্বলেছিল, যার পরিণামে গ্রাহকরা যেমন সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন, তেমনই কর্মচারীরাও তাঁদের কাজ হারিয়েছিলেন। বর্তমানের বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে দেখছি কর্মী ছাঁটাই চলছে অবাধে। একটি লব্ধপ্রতিষ্ঠ বেসরকারি ব্যাঙ্ককে দেখছি তারা তাদের বিশাল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে। সে কারণেই বোধ করি ব্যাঙ্কের মধ্যে কোনও ইউনিয়ন গঠিত হোক— তা তারা চায় না। ছাঁটাই নিয়ে লেবার কমিশনের ডাকা ত্রিপাক্ষিক বৈঠককে পর্যন্ত উক্ত ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে চলছেন।
গৌরীশঙ্কর দাস, সম্পাদক, অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় ইউনিটি ফোরাম
হেনস্থা থামুক
‘ফের হেনস্থার নালিশ, উদ্ধার ছাত্রীর ঝুলন্ত দেহ’ (২৭-৭) সংক্ষিপ্ত খবরটি মনকে অত্যন্ত বিষণ্ণ করে দিল। এ ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়, ছাত্রছাত্রীদের মানসিক হেনস্থার মূল কারণ, কলেজ অধ্যাপকদের অন্যায়, যাকে বলা হচ্ছে মানসিক নির্যাতন। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে অভিযুক্ত অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করার কোনও আইন বোধ করি নেই।
বহু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলিতে। উচ্চশিক্ষিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই সব ছেড়ে চলে যাওয়ায় কি দেশের শিক্ষা-সম্পদের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর নয়? এ বিষয়ে শীর্ষ আদালতের যে নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কোথায় কোথায় কী দোষ ত্রুটি ও তার প্রতিকার কী হতে পারে। প্রতিকারগুলি নিয়ে কঠোরতা প্রয়োজন, দেশের স্বার্থেই। প্রয়োজন নৈতিক দায়বদ্ধতা, জনজাগরণ।
তপন কুমার দাস, কলকাতা-১২২
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)