স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের ‘বাঙালি পরিচয়ের রাজনীতি’ (১৫-৪) প্রসঙ্গে কিছু কথা। চারিদিকের আলোড়নে প্রশ্ন ওঠে যে তবে কি বাংলা ভাগের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দায়ী ছিলেন? আহমেদ ছফার মতে, বঙ্কিম নাকি সর্বপ্রথম একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আনন্দমঠ-এর মধ্যেই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূর্ণ দৈর্ঘ্যে মুক্ত হয়েছিল। এ কথা সত্যি যে, বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি তথা ভারতবাসীর আত্মবোধকে জাগ্রত করেছেন। তিনি ভারতীয় জাতিতত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি প্রতিটি সম্প্রদায়ের হৃদয়ে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। জাতীয়তাবোধ বা ভারতীয়ত্ববোধ সম্পর্কে ভারতবাসীকে তিনি সচেতন এবং শিক্ষিত করে তুলেছেন, যা পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রকে মজবুত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর জাতীয়তাবাদ, ধর্মব্যাখ্যা, মানবপ্রেম, যুক্তিবাদ প্রভৃতির উপর বিশেষ আলোকপাত হয় না এবং সভাসমিতিতে আলোচনাও শোনা যায় না।
কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বঙ্কিম-বিরোধিতা চলছে। বেশ কিছু লেখক ও বুদ্ধিজীবী বঙ্কিমের উপন্যাস ও প্রবন্ধ থেকে বেছে বেছে এমন কিছু পঙ্ক্তি নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেন যা পড়ে বহু পাঠক বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। ওই বুদ্ধিজীবীরা বঙ্কিমকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে তুলে ধরতে চান। সেই কারণে তাঁরা বঙ্কিমের লেখা থেকে ঠিক ততটুকু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন, যতটুকু তাঁদের স্বার্থ পূরণের কাজে লাগে। অর্থাৎ, বঙ্কিমের মূল বক্তব্যের বিকৃতি এবং অবনমন ঘটানো হয়। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের দ্বারা পরিপুষ্ট বেশ কিছু লেখক ও বুদ্ধিজীবী আছেন, যাঁরা বঙ্কিমকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে তুলে ধরতে আগ্রহী। তাঁরাও রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করতে চান। সুতরাং, তাঁরা আর যা-ই হোন, সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী মনের অধিকারী নন।
বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদী চিন্তায় বলা হয়েছে, সমস্ত সম্প্রদায়ের আত্মিক মিলনের দ্বারা ভারতীয় জাতি গঠনের কথা। তাঁর ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকে একই আত্মার বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে। সুতরাং, বঙ্কিমকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে চিহ্নিত করতে পারলে জাতীয়তাবাদের উপর কিছুটা আঘাত হানা সম্ভব এবং রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিশেষে এ কথা বলা যায়, যাঁরা রাজনৈতিক স্বার্থে বঙ্কিমের বিরোধিতা করছেন তাঁরা প্রকৃতপক্ষে সমাজকে কলুষিত করছেন এবং ধর্মের নামে দ্বন্দ্বকে জিইয়ে রাখার প্রয়াসে সদা লিপ্ত রয়েছেন।
নারায়ণ সাহা, কলকাতা-৮৪
মৈত্রীর পূজারি
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের ‘বাঙালি পরিচয়ের রাজনীতি’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জানাই যে, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ও ‘বন্দে মাতরম্’কে কেন্দ্র করে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের যে উজ্জীবন ঘটেছিল তা অভূতপূর্ব। ভবানন্দের গাওয়া ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত যেন সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদের আবাহন। জন্মভূমির পরাধীনতার বেদনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে এই জাতীয়তাবোধের প্রকাশ ঘটেছিল। তিনি বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই জাতীয়তাবোধের বোধনমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। এ সঙ্গীত বাঙালিদের স্বদেশপ্রেমে দীক্ষিত করেছিল। ‘বন্দে মাতরম্’কে কেন্দ্র করে সারা ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার আসার সময় এর হিন্দুত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। পরবর্তী কালে রাজনৈতিক মতবাদকে কেন্দ্র করে অবশ্য নানা প্রশ্ন ওঠে।
‘ভারত কলঙ্ক’ প্রবন্ধেও বঙ্কিমচন্দ্র ‘জাতি’ শব্দে ন্যাশনালিটি বা নেশন-কে বুঝিয়েছেন, বিশেষ গোষ্ঠী বা ধর্মকে নয়। দার্শনিক কমলাকান্তের মধ্য দিয়েও বঙ্কিমচন্দ্র সমগ্র মনুষ্যজাতির প্রতি সুগভীর প্রীতির পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মানবধর্মের আদর্শ কমলাকান্ত বলেছেন, “মনুষ্যজাতির প্রতি যদি আমার প্রীতি থাকে তবে আমি অন্য সুখ চাই না।” এটাই বঙ্কিমের মানবতা। সমগ্র মনুষ্যজাতির প্রতিই তাঁর এই প্রীতি ও সৌহার্দ ছিল। তিনিই বলতে পারেন “পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল্য নাই”। আর ‘আমার দুর্গোৎসব’ রচনাতেও এক দিকে তাঁর বাঙালিয়ানা, অপর দিকে তাঁর স্বদেশচিন্তার তীব্র প্রকাশ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বিশ্বমৈত্রীর পূজারি। প্রেম, প্রীতি ও মৈত্রীর আদর্শ প্রচার করে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যসাধনে তিনি ব্রতী ছিলেন। কী হিন্দু, কী মুসলমান— সকলের প্রীতিই ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের আকাঙ্ক্ষিত। হিন্দু-মুসলমানের তারতম্য নির্দেশ করা তাঁর গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর সাহিত্যে হিন্দুত্বের আড়ম্বর থাকলেও তার সত্যকার প্রতিপাদ্য হিন্দুত্ব নয়, মানবতা। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের পূজারি। আনন্দমঠ উপন্যাসেও তাঁর এই চিন্তা ব্যক্ত চিকিৎসকের উক্তিতে। চিকিৎসক, সত্যানন্দকে বলেছেন, “কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না...”। মহাপুরুষের স্পষ্ট উক্তি, “এখন ইংরেজ রাজা হইবে।”
বঙ্কিমচন্দ্র স্মরণ করিয়েছেন প্রজায় প্রজায় প্রভেদ পাপ। তাঁর মতে হিন্দু, মুসলমান-সহ সমস্ত প্রজার সুরক্ষা ও মঙ্গলবিধানই রাজার ধর্ম। সীতারাম-এ মুসলমান ফকির চাঁদশাহের মুখ দিয়ে হিন্দু রাজা সীতারামের উদ্দেশে বলেছিলেন, “বাবা! শুনিতে পাই, তুমি হিন্দু রাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু অত দেশাচারে বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে....”। চাঁদশাহ ফকির সীতারামকে পরামর্শ দিচ্ছেন, হিন্দু ও মুসলমানের প্রতি সমদর্শী হতে। আবার রাজসিংহ উপন্যাসের উপসংহারে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “গ্রন্থকারের বিনীত নিবেদন এই যে, কোনো পাঠক না মনে করেন যে, হিন্দু-মুসলমানের কোনোপ্রকার তারতম্য নির্দেশ করা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য।” স্বভাবতই বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ বঙ্কিমচন্দ্রকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নির্মাতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কাজেই মানবতাবাদী ভাবধারার আদর্শে উদ্বুদ্ধ বঙ্কিমচন্দ্রকে কেউ বাংলা ভাগ করার জন্য দায়ী করলে মানতে অসুবিধা থাকেই।
সুদেব মালতিসা, হুগলি
পুনরুত্থানের স্বপ্ন
‘অবহেলার ঐতিহ্য’ (১০-৫) লেখাটিতে লেখক অশোক মুখোপাধ্যায়ের আলোকপাতে ভাস্বর অনেক জানা-অজানার কাহিনি। স্টার থিয়েটার, রঙমহল, বিশ্বরূপা হলগুলি অতীতের বহু স্মৃতি বহন করে এখন দৈন্যদশায় ভুগছে। সেই স্টার থিয়েটার যার সঙ্গে নটী বিনোদিনী এবং নাট্যব্যক্তিত্ব ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের আত্মিক যোগ ছিল, সেখানে আর নাটক মঞ্চস্থ হয় না। সেই মঞ্চে নট-নটীদের পায়ের আওয়াজ ও প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের কলধ্বনি শোনা যায় না। অনুষ্ঠিত হয় সিনেমার প্রদর্শনী।
রঙমহল, বিশ্বরূপাও কিংবদন্তি নাট্যপ্রতিভাদের স্মৃতিধন্য নাট্যগৃহ হিসাবে পরিচিতি। না, সেগুলোতেও আর নাট্যাভিনয় হয় না। এমন আরও কিছু নাট্যমঞ্চ ডুবে আছে অবলুপ্তির অন্ধকারে। এই ডিজিটাল ও উন্নত প্রযুক্তির যুগেও বিভিন্ন জেলায়, শহরে, গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বহু নাট্যমঞ্চে এখনও অনেকে নাটক দেখেন ও তার গঠনমূলক সমালোচনাও করে থাকেন। তবে সিনেমা দেখাটাই যেখানে অবিশ্বাস্য রকমে হ্রাস পেয়েছে, সেখানে নাটক বা থিয়েটার দেখার ধারা বিপন্ন তো হবেই। মানুষ যাতে নাটক বা থিয়েটারে আবার আগ্রহী হন, তার জন্য সব রকমের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর তাই অতীতের স্মৃতিবিজড়িত নাট্যমঞ্চগুলির পুনরুজ্জীবন একান্তই প্রয়োজন।
শুভেন্দু নন্দী, মালদহ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)