E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ভরসা আদালত

এক দিকে এত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী, যাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অন্য দিকে, এত ছাত্রছাত্রী, যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হয়ে আসছিল।

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৫ ০৭:০৫

গত ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাপক দুর্নীতির কারণে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হল। এর ফলে সমাজের ভাল হল না মন্দ, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই চিঠি। এক দিকে এত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী, যাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অন্য দিকে, এত ছাত্রছাত্রী, যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হয়ে আসছিল।

তুল্যমূল্য বিচারে সহজেই অনুমেয় যে, মহামান্য হাই কোর্ট এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে সেটি সমাজের পক্ষে হিতকর। এর দু’টি দিক আছে। এক আগামী প্রজন্ম, যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হতে বসেছিল, তারা আলো খুঁজে পাওয়ার সুযোগ পাবে। দুই, যারা ষড়যন্ত্র করে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় দুর্নীতি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের সাজা মেলার সম্ভাবনা বাড়ল। অতএব সাধারণ নাগরিক হিসাবে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো উচিত। আদালত মানেই ন্যায় পাওয়ার জায়গা। সেই হেতু আদালত আজকের রায় দ্বারা সমাজের সবার প্রতি ন্যায় করেছে বলেই মনে হয়। মোট ২৫,৭৫৩ জনের মধ্যে আবার অযোগ্য বলে চিহ্নিতদের গৃহীত বেতনের উপর ১২% হারে সুদ-সহ টাকা ফেরতের নির্দেশ দেওয়াকেও স্বাগত জানাই। আগামী দিনে এ রকম দুর্নীতি করতে বা দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষার মতো জায়গায় অন্তর্ভুক্ত হতে মানুষ দ্বিতীয় বার চিন্তা করবে।

এ-যাবৎ সংবাদমাধ্যমগুলিতে চাকরিহারাদের কান্না, তাঁদের অভিব্যক্তি, সরকারের দোষ-ভুল ইত্যাদি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ২০১৬ সালে যে শিশুরা পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছিল এত দিনে তারা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করেছে। ওই শিক্ষকদের মাধ্যমে তারা কী শিক্ষা পেয়েছে, সেটার বিশ্লেষণ আমরা কেউ কি করেছি? এ ভাবে স্কুলে স্কুলে দুর্নীতিগ্রস্ত মাস্টারমশাইদের অনুপ্রবেশ করিয়ে সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে টিউশন নির্ভর করে তোলা হয়েছে। স্কুলগুলি কেবল সার্টিফিকেট আদায়ের মাধ্যম হয়েছে। পড়াশোনা আর স্কুলে হয় না। মাস্টারমশাইদের তাই ছাত্ররা সম্মানও করে না। কারণ শিক্ষক হতে গেলে নির্দিষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু আচার-আচরণের প্রয়োজন হয়, যেগুলি এই সব দুর্নীতিগ্রস্ত মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে আছে কি না সন্দেহ।

প্রাথমিকের ক্ষেত্রেও এই একই অনিয়মের অভিযোগ। এই দুর্নীতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, বর্তমানে ছোট থেকে বড় যা কিছু সমস্যা সবেতেই আদালতের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে। মানুষ এখন প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি করাটাকে খুবই সহজ মনে করছে। এ ক্ষেত্রে আদালতই এই দুর্নীতির হাত থেকে সাধারণ মানুষ এবং সমাজকে রক্ষা করার একমাত্র ভরসাস্থল।

প্রবীর আদক, পূর্বকোলা, পূর্ব মেদিনীপুর

যোগ্য উপায়

‘২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বাতিলে বলি যোগ্যরাও’ (৪-৪) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। এ বছরের ৩ এপ্রিল তারিখটা নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটা ‘কালো’ দিন হিসেবেই চিহ্নিত হবে। নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে এক সঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ আগে কোনও দিন দেশে ঘটেনি।

কলকাতা হাই কোর্টের আগের নির্দেশ বহাল রেখে শীর্ষ আদালত যে রায় দিয়েছে, তার দুটো দিক রয়েছে। এক দিকে, প্রশাসনিক দুর্নীতির শিকার হলেন বেশ কিছু নিরীহ প্রার্থী, অন্য দিকে অযোগ্যরা তাঁদের কৃতকর্মের জন্য যথোপযুক্ত ভাবে শাস্তি পেলেন। শেষোক্ত প্রার্থীর সংখ্যা ৬,২৭৬ জন, যাঁরা জালিয়াতি, প্রতারণা করে চাকরি পেয়েছেন। শীর্ষ আদালত তার রায়ে এটাও জানিয়েছে, নিয়োগে অনিয়মের তথ্য ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও স্কুল সার্ভিস কমিশন তার খামতি ও অনিয়মগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে। এই ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টার ফলে (যোগ্য-অযোগ্যদের) যাচাই এবং চিহ্নিত করা আরও কঠিন কাজ হয়ে পড়েছে। কিন্তু, একই সঙ্গে, শাস্তি প্রয়োগ বা শাস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রে তারা আবার দুটো ভাগও করেছে। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এক দিকে উল্লিখিত ‘অযোগ্য’দের জন্য পুরো বেতন সুদ-সহ ফেরত দেওয়ার নির্দেশের সঙ্গে শূন্যপদ পূরণের নিয়োগে তাঁরা যোগ দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছে। অপর দিকে, বাকিদের এই শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া ছাড়াও পুরনো চাকরির জন্য আবেদন করার অনুমতিও আদালত দিয়েছে।

আমাদের বিচারব্যবস্থার মূল কথা— কোনও অভিযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড় পেয়ে গেলেও কোনও নির্দোষ যেন কখনও শাস্তি না পায়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে উপরোক্ত শাস্তির জন্য চিহ্নিত ওই ‘অযোগ্য’দের বাদ দিয়ে অন্য অযোগ্যদের যদি প্রমাণের অভাবে আদালত ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিয়ে থাকে, তা হলে বলব তারা ঠিক কাজই করেছে। তবে, প্ৰকৃত ‘যোগ্য’দের জন্য চাকরি বাতিলের যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তার প্রভাবটা যদি কিছুটা কমানো সম্ভব হত, তা হলে মনে হয় তাঁদের প্রতি কিছুটা ‘সুবিচার’ করা যেত।

যাঁদের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতি’র কোনও অভিযোগ নেই, বয়সের ক্ষেত্রে ছাড়ের সুবিধে নিয়ে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া, এবং চাকরি পাওয়ার কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন তাঁরা যাতে না হন, সেই ব্যবস্থা করা— এগুলি যদি মহামান্য আদালতের বিচার-বিবেচনায় থাকে, তা হলে ভাল হয়।

মানবিক কারণেই, এক বারের জন্য অন্তত ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের সাফল্যে পৌঁছনোর রাস্তাটা কিছুটা সুগম করে দেওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।

গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪

কঠিন পদক্ষেপ

গত বছর এপ্রিল মাসে কলকাতা হাই কোর্ট ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োজিত শিক্ষক, অ-শিক্ষক কর্মীদের যে প্যানেলকে বাতিল করেছিল, তাতে কিছু পরিমার্জন করে সেই রায়কেই বহাল রাখল সর্বোচ্চ আদালত। এক সঙ্গে চলে গেল ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি। প্যানেলের হিসাব অনুযায়ী যেখানে ৬,২৭৬ জন অনৈতিক ভাবে চাকরি কিনেছিলেন, সেখানে গোটা প্যানেল বাতিল করে দেওয়া মানে বর্তমান সময়ের নিরিখে একটা গোটা প্রজন্মকে অন্ধকার দিকে ঠেলে দেওয়া। আদালতের এই রায় প্রকাশের পরেই রাজ্যের শাসক ও বিরোধী সব দলই আসরে নেমেছে। বিরোধীদের বক্তব্য, তাঁরা যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের পাশে থাকবেন এবং লড়াই চালিয়ে যাবেন। সেই সঙ্গে আদালতকে এই রায় নিয়ে যোগ্যদের স্বার্থে একটু সময় দেওয়ার আবেদন জানাবেন। অথচ, এই আবেদন আগে করলেও সম্পূর্ণ বিষয়টি বিশদে পুনর্মূল্যায়ন করা সম্ভব হত। অর্থাৎ, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি জড়িয়ে ছিল।

বাতিল হওয়া যোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই বা সকলেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নও করে এসেছেন। তাঁদের সেই অবদানকে কি আরও একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখা যেত না? মহামান্য আদালতের রায় শিরোধার্য মেনেও এ কথা বলা যায়, এই নিয়ে হয়তো আরও বিশদ মূল্যায়নের প্রয়োজন ছিল। উচ্চ আদালত এবং রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের উচিত, যে সকল নেতা, কর্মীর কারণে রাজ্যে এই কালো দিন ঘনিয়ে এসেছে, একটা প্রজন্ম দিশাহীন হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করা— তবেই বিনা দোষে যাঁরা লাঞ্ছিত হলেন, তাঁদের প্রতি ন্যায় করা হবে। যাঁরা হাজার হাজার যুবক-যুবতীর অক্লান্ত পরিশ্রমের গুরুত্ব বোঝেং না, রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন হন না, তাঁদের বাঁচানো মানে রাজ্যের ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া। রাজ্যের হাল ফেরাতে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাবই পথ, যাতে আগামী দিনে কেউ বিপথে এগোতে সাহস না পায়।

শুভজিৎ বসাক, কলকাতা-৫০

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengal Teacher Recruitment Case West Bengal SSC Scam Primary Teacher Recruitment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy