অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ (৩০-৮) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। প্রবন্ধকার সুচারু ভাবে বাংলা থিয়েটারে প্রতিবাদের যে পরম্পরার কথা বলেছেন, তা যেমন বিশ্লেষণধর্মী, তেমনই বস্তুনিষ্ঠ।
থিয়েটার এবং প্রতিবাদ হাত ধরাধরি করে চলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই আলোচনাটির মধ্যে বাদল সরকারের অনুপস্থিতি ব্যথিত করল। তিনি তাঁর ‘থার্ড থিয়েটার’-এর মাধ্যমে যে ভাবে দর্শকের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং তা করতে গিয়ে প্রতিবাদের ভাষার একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বর সৃষ্টি করেছিলেন তার উল্লেখ করাটা খুব জরুরি ছিল। প্রসঙ্গত উৎপল দত্ত নির্দেশিত ও অভিনীত মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনের আধারে রচিত দাঁড়াও পথিকবর নাটকটিও দীর্ঘদিন সুবিপুল জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকটি বাংলা প্রতিবাদী নাটকের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হয়। নাটকটি বর্তমানে পুনরায় অভিনীত হচ্ছে যা দর্শকবন্দিতও বটে। আবার রঙ্গলোক প্রযোজিত সমরেশ বসুর উপন্যাস অবলম্বনে তীর্থঙ্কর চন্দের লেখা প্রতিবাদী নাটক শিকলছেঁড়া হাতের খোঁজে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। উদাহরণের সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই।
পরিশেষে বলা যায় যে প্রবন্ধকার এই সময়ে জনাদৃত কয়েকটি পুরনো নাটকের পুনরভিনয়ের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও ঠিক বর্তমানের প্রচারের যুগে শহরে ও বিশেষত মফস্সলে এমন অনেক নাট্যদল আছে যারা অনেকটাই অনাদৃত। অথচ তাদের কিছু কিছু প্রযোজনা আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়। কিন্তু প্রচারের আলো তাদের উপর পড়ে না এবং সর্বোপরি বর্তমানে নাটক প্রযোজনার জন্য যে সুবিপুল অর্থরাশি আবশ্যক, তা বহন করার মতো সাধ্য অনেকেরই নেই। সারা বছর হলগুলিতে নিজেদের প্রযোজনা মঞ্চস্থ করার আনুকূল্য ক’জন পান? অথচ তরুণ প্রজন্মের একটি আলোকপ্রাপ্ত অংশ শুধুমাত্র নাটকের টানে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দৈনিক যাতায়াত করে এই সব প্রযোজনার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখেন বলে আমরা অনেকেই জানি। এখানেই বড় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে ‘এজিটপ্রপ’ কিংবা ‘থার্ড থিয়েটার’ বা ভিন্নতর ধারা। জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের অনাবশ্যক মঞ্চায়ন, আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবিত চোখধাঁধানো প্রকরণ, কিংবা টিভি সিরিয়াল-লালিত ‘স্টারডম’ যেন কালজয়ী নাটকগুলির বিপ্লবী দর্শনকে হারাতে না পারে, সে দিকে নজর রেখে নাট্যকার, নির্দেশক, কুশীলব, দর্শক, বুদ্ধিজীবী সবাইকেই সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
কালিদাস আচার্য, কলকাতা-৮৪।
বদলের ধারায়
অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ প্রসঙ্গে এই চিঠি। রাজনীতি ও থিয়েটারের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বাংলা নাটকের প্রতিবাদী চরিত্রের ইতিহাসকে ধরেছেন।
এ বিষয়ে জানাই, অতিবাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী কিছু গোষ্ঠী অবশ্য মঞ্চে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা কিছু দিন বলেছিল। কিন্তু বাংলায় নকশাল যুগ শেষ হওয়ার পর ওই ধরনের নাটকের দিন শেষ হয়ে যায়। একমাত্র উৎপল দত্ত তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ধরে রেখেছিলেন এবং এর ফলে তাঁর নাট্যজীবনে সঙ্কট দেখা যায়, যা প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন। দেশে অন্য বিপ্লবের কাহিনি শুনিয়েছিলেন। ডিরোজ়িয়ো যিনি ছাত্রদের চিন্তায় বিপ্লব এনেছিলেন, মাইকেল মধুসূদন যিনি বাংলা নাটকে বিপ্লব এনেছিলেন— উৎপল দত্ত এঁদের কাহিনি এনেছিলেন মঞ্চে।
তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলা নাটকের ইতিহাস প্রতিবাদী নাটকের ইতিহাস। নবান্ন দিয়ে যার পথ চলা শুরু। উৎপল দত্ত এবং অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটারের হাত ধরে বাংলা প্রতিবাদের নাটকের ইতিহাস রচিত হয়েছে। পৃথিবীকে খালি বুঝলেই হবে না, একে বদলাতে হবে। ব্রেখটের এই কথার রেশ ধরে বলতে হয় বদলাতে হবে সমাজকে।
বাংলা থিয়েটারে এর সুস্পষ্ট সাক্ষ্য আছে। পরাধীন ভারতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের হাত ধরে থিয়েটার শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের প্রতিবাদকে মঞ্চে তুলে এনেছিল। ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে সমাজবদলের ব্রত নিয়েছিল। স্বাধীন হওয়ার পরও গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। শাসক শ্রেণি, পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের পুরোপুরি সমাজের শত্রু রূপে চিহ্নিত করে যে নাটক তৈরি করার চল হয়েছিল তার যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেও বলা যায় সেগুলি কয়েক দশক ধরে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
তার পর সত্তরের দশকের শেষার্ধে শাসক পরিবর্তন হল। কিছু দিন পর মনে হচ্ছিল কেমন যেন বেসুরো বাজছে। শাসক আর শোষককে এক পঙ্ক্তিতে বসানো যাচ্ছে না। পুলিশকে আর চোখ বুজে অত্যাচারী বলা যায় না। শিল্পপতিদের হাত ধরে উন্নয়ন হয়— শ্রমিক শ্রেণি উপলব্ধি করেছে। ফলে থিয়েটারের মঞ্চে প্রতিবাদের ভাষা বদলে গেল। সাড়ে তিন দশকের বামপন্থী শাসনকালে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির চরিত্র বদলে গেল, উদ্যোগপতিরা বামপন্থীদের বন্ধু হলেন, তাঁদের সুযোগসুবিধা দিয়ে রাজ্যে শিল্প স্থাপনের আহ্বান জানানো হল মানুষের কাজের সুযোগের কথা মাথায় রেখে। ‘শিল্পপতিদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগান এখন অতীত। বাংলার নাট্যদলগুলি, যারা গত অর্ধশতাব্দী ধরে যে প্রতিবাদের নাটক করে অভ্যস্ত ছিল তারা দিশাহারা হয়ে পড়ল। একাঙ্ক নাটকের মঞ্চগুলি প্রাসঙ্গিক নাটকের অভাবে ধুঁকতে লাগল। পুরাণ বা ইতিহাস থেকে কাহিনি আহরণ করে আধুনিক জীবনের ছাঁচে ঢেলে পরিবেশন করল। অনেকে নাটক লিখলেন সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে সমাজবিপ্লবীদের সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে। মোট কথা থিয়েটার নতুন পরিস্থিতিতে সংগ্রামী চরিত্র হারায়নি।
কিন্তু গত দেড় দশকে নতুন সরকারের আমলে যে সামাজিক বিপ্লব হল, রাজ্যের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি নানা রকম সরকারি সাহায্য পেয়ে পুষ্ট হল, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত থেকে নিম্নবিত্তের হাতে চলে গেল সেটা ঠিক থিয়েটারে প্রতিফলিত হল না। কেন, তার নানা কারণ আছে, তা সকলের জানা।
তাই প্রতিবাদী নাটক নিয়ে মঞ্চে মঞ্চে হাজির হওয়ার আবার উপযুক্ত সময় এসেছে। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের আদর্শে উদ্বুদ্ধ থিয়েটার দলগুলির পালে আবার বাতাস লেগেছে। তারা এই সুবাতাসে ভর করে তাদের প্রতিবাদের নাটক কত দূরে নিয়ে যায় এটাই দেখার।
ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলি।
উৎপল-স্মরণে
অশোক মুখোপাধ্যায় ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ প্রবন্ধে নাট্যশিল্প সম্পর্কে, তার ভিতরের চরিত্র এবং নাট্যধারা সম্পর্কে লিখেছেন। বিশেষ ভাবে এসেছে উৎপল দত্ত সম্পর্কে কিছু কথা। নাটক রচনা, প্রযোজনা অভিনয় ছাড়াও চলচ্চিত্রের আঙিনায় তিনি সফল মানুষ। প্রতিভাবান এই অভিনেতা আজ বহু কারণে এক মিথ। কখনও কখনও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনও ব্যক্তিত্বের তাত্ত্বিক কোনও কারণে মতভেদ ঘটলেও উৎপল দত্ত বাম ও মার্ক্সবাদ সংস্রব ত্যাগ করেননি। আশ্চর্য লাগে অস্থিরতার যুগে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা তাঁকে বিরূপ চোখে দেখছে, জরুরি অবস্থা নিয়ে তিনি প্রযোজনা করছেন দুঃস্বপ্নের নগরী ইত্যাদি, গ্রেফতার হচ্ছেন এবং স্বয়ং সত্যজিৎ রায় যাচ্ছেন তাঁকে কারামুক্ত করতে, এ রকম ঝঞ্ঝার সামনে ব্যারিকেড, মহা-বিদ্রোহ, টিনের তলোয়ার প্রভৃতি উন্নত মানের নাটক প্রযোজনা করে চলেছেন আবার হিন্দি ও বাংলা ছবিতেও অভিনয় করে চলেছেন।
উৎপল দত্ত মনে করতেন যে নাটকে হাস্যরস নেই সে নাটক হাস্যকর। বলতেন, ঢেকেরেখে বা এড়িয়ে যাওয়া নয়, সব কিছুকে খোলামনে বিচার করতে হয়। তাঁর ছিল নিষ্ঠা এবং নাট্যবোধ। জন্মশতবর্ষের কিছু আগে থেকেই তাঁর ও তাঁর নাটক সম্পর্কে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে এটাই আশার।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)