E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: কালজয়ী দ্যুতিবলয়

লেখনী পাঠককে খেয়াল করিয়ে দিয়েছে মহানায়কের সাংস্কৃতিক কৌলীন্য না-থাকাই জনসাধারণের এক জন থেকে ক্রমশ তাঁকে ‘মিথ’-এ পরিণত করেছিল, এবং কেন তিনি নগরপল্লিতে লোকগাথার অবিসংবাদিত সম্রাট হয়ে ওঠেন!

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৪

অধ্যাপক, গবেষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘উত্তমচরিতমানস’ (রবিবাসরীয়, ৩১-৮) প্রসঙ্গে এই চিঠি। এই প্রবন্ধ বিদ্বানবৃত্তকে প্রশ্ন করতে শেখাল, কেন মহানায়ক চরিত্রলিপি ও গ্ল্যামার সরিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম্! উত্তম-স্তুতির আড়ালে চিরকাল অনালোচিত তাঁর মুখচ্ছবিতে ফুটে ওঠা অস্তায়মান সৌরকরের মতো ফুটে ওঠা আধ্যাত্মিক বিষাদের উপর লেখক আমাদের দৃষ্টি ফেরালেন।

উদাহরণ-সমেত স্মরণ করিয়ে দিলেন, কী ভাবে তিন দশক ধরে উত্তম-রহস্য ছড়িয়ে পড়েছিল সংস্কৃতির অচেনা স্তর থেকে স্তরান্তরে। এ লেখনী পাঠককে খেয়াল করিয়ে দিয়েছে মহানায়কের সাংস্কৃতিক কৌলীন্য না-থাকাই জনসাধারণের এক জন থেকে ক্রমশ তাঁকে ‘মিথ’-এ পরিণত করেছিল, এবং কেন তিনি নগরপল্লিতে লোকগাথার অবিসংবাদিত সম্রাট হয়ে ওঠেন! সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় গদ্যসাহিত্যের আঙিনায় সর্বদাই উচ্চমার্গীয় এবং ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গির ধারক, তিনি আবারও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে নতুন দিশা দেখালেন, বোঝালেন কেন মহানায়ক তাঁর পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক নায়কদের মতো ছদ্মবেশী দেবতা না হয়ে, হয়ে উঠেছিলেন নলের মতো দেবতা! কেন উত্তমকুমার ইতিহাসের ‘মাস অর্নামেন্ট’ হয়ে থেকে যাবেন।

লেখকের যুক্তিনির্ভর গদ্য আমাদের চিন্তাকে আলো দেখায়— কী ভাবে উত্তমকুমার চিত্রনাট্য ছাপিয়ে অভিনয়, কটাক্ষ, সংলাপ উচ্চারণ, হাসির দ্বারা ক্রমশ মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে যে স্বপ্নের পরিসর প্রয়োজন ছিল, তাই উত্তমকুমার রচনা করেছিলেন। দর্শকের রুচি ও মত্ততার সীমারেখা তিনি সম্যক জানতেন, তাই তো আজও তিনি মহানায়ক।

দেবযানী ভট্টাচার্য, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

মায়াভুবন

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘উত্তমচরিতমানস’ পড়ে ঋদ্ধ হলাম। আমি মহানায়ক, অভিনেতা উত্তমকুমারের অন্ধ ভক্ত। ওই রকম রোম্যান্টিক দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে আজ পর্যন্ত কাউকে দেখলাম না। মাথা নিচু থাকা অবস্থায় হঠাৎ ওই যে চোখ তুলে তাকাতেন, এক কথায় অসাধারণ! আর একটি অননুকরণীয় গুণ হল, যে কোনও গানে সুন্দর লিপ দেওয়া। জুলাই মাসটা এলে মনটা ভারী হয়ে যায়। মনে হয় উত্তমকুমার বেঁচে থাকলে বড় ভাল হত। বয়স অনেক হয়ে যেত, অভিনয় হয়তো করতে পারতেন না, কিন্তু থাকতেন আমাদের মাঝে, আমাদের সঙ্গে। চেহারার সৌন্দর্য এক দিন ম্লান হয়ে যেত, কিন্তু ব্যক্তিত্বে মরচে পড়ত না। যিনি নিজের সীমারেখা জানেন, ভদ্রতায় দৃঢ় থাকেন, তাঁকে চিরকাল সবাই সম্মান করে, ভালবাসে।

বাঙালির ম্যাটিনি আইডলের জন্মশতবর্ষ সূচনা হয়েছে। উত্তমকুমার যেমন বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন, ঠিক তত বড় মনের মানুষ ছিলেন। সহশিল্পীদের লেখা পড়ে জেনেছি উত্তমকুমার খেতে যেমন ভালবাসতেন, তেমনই খাওয়াতেও ভালবাসতেন। বাংলা সিনেমাজগতে উত্তমকুমারের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে। মহানায়ক হয়েও কী ভাবে সহ অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করতে হয়, মিশতে হয়— তাঁর কাছে শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। সহশিল্পী ও সিনেমা-টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে মনে করতেন একটি বৃহত্তর যৌথ পরিবার। এই সব পরিবারের কত মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, কত জনের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

পরবর্তী সময়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সহ এক ঝাঁক নতুন মুখ সিনেমাজগতে পা রাখলেও উত্তমকুমারের জায়গা ঠিকই ছিল। কিন্তু এই সময় থেকে অতিরিক্ত কাজের চাপ, পারিবারিক ও মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শরীর ভাঙতে শুরু করেছিল। ছাপ পড়েছিল তাঁর মুখমণ্ডলে ও চেহারায়। বয়স এমন কিছু না হওয়া সত্ত্বেও সেই সময় থেকে তাঁকে চরিত্রাভিনয়ের দিকে সরে যেতে হয়েছিল। তাঁর হাসি, রোম্যান্টিসিজ়ম, চুলের স্টাইল দেখে মুগ্ধ হয়েছে কিশোর-কিশোরী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। অনেক যুবক তাঁকে অনুকরণের চেষ্টা করেছে।

বর্তমানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গভীর সমস্যায়। মনে পড়ে সেই গান, ‘শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত/ অনেকেরই বলার সময় খেয়াল থাকে না।’ উত্তমকুমার তাঁর শেষ ছবি ওগো বধূ সুন্দরী-তেই বাংলা উচ্চারণ ও অন্যান্য ভাষাকে বাংলা ভাষার মধ্যে ঢুকিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষা তৈরির চেষ্টার প্রতি কৌতুক-মোড়া প্রতিবাদ ও শ্লেষাত্মক বক্তব্য রেখে গিয়েছেন।

তাঁর সৃষ্টিকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন মুগ্ধতার মায়াভুবনে। এই সৃষ্টি চিরকালীন। প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য। কিন্তু তাঁর সব ছবি সংরক্ষণ করা যায়নি। এ অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখের। স্রষ্টা চলে যান, রেখে যান তাঁর উজ্জ্বল সৃষ্টিকে। তার মাধ্যমে তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকেন। সেই সৃষ্টিকে ভাবীকালের হাতে তুলে দিতে পারলে, তবেই জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্ভব।

গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

অতুলনীয়

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ‘উত্তমচরিতমানস’ প্রবন্ধ পড়ে দু’টি কথা মনে এল। প্রথম দিকের বউঠাকুরাণীর হাট ছবিতে একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রের স্ত্রীকে তাঁরই মা বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। স্ত্রীর জন্য হাহাকার ও মায়ের প্রতি অসহায় ক্ষোভে স্ত্রীর মৃতদেহকে নিয়ে আলিঙ্গন করে তাঁর অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠের অনুরণন ভোলা যায় না। এই দৃশ্যে উত্তমকুমারের ওষ্ঠের কাঁপন ও চোখের জলকে চোখের গণ্ডির মধ্যে রেখে দেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা আমরা প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলাম।

দ্বিতীয় ছবিটি হল মহানায়কের একটু বেশি বয়সের ছবি অমানুষ। চেনা উত্তমকে বয়সের ভারে একটুও ফিকে লাগে না। এখানে উত্তম এক জন আহত প্রেমিক মধু। এই বেদনা উত্তম ছাড়া হয়তো আর কারও পক্ষে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না।

প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি

সবার উপরে

শুভাশিস চক্রবর্তীর “নিজের গায়ের দামি শাল খুলে জড়িয়ে দিয়েছিলেন শীতার্ত কনস্টেবলের গায়ে” (রবিবাসরীয়, ২৭-৭) শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। ছবি বিশ্বাসের অভিনয় দক্ষতার একাধিক নিদর্শনের মধ্যে একটি বিশেষ অভিনয় নিয়ে আমি আলোকপাত করতে চাই। সিনেমার নাম সবার উপরে।

“...দাও, ফিরিয়ে দাও আমার বারোটা বচ্ছর। ফিরিয়ে দাও সেই আমার বারোটা বচ্ছর। যে বারোটা বছর নির্দোষ হয়েও এই জেলখানার নরকের মধ্যে পচে নষ্ট হয়ে গেছে।” এই সংলাপ বলার সঙ্গে অভিনেতার দুই বাহু সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মর্মস্পর্শী আকুতি যেন সীমাহীন দুর্দশা ও কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এমন আবেগ আর অভিব্যক্তি আমি ভুলতে পারি না। কারাগারে বন্দি থেকে থেকে হয়তো অন্ধকারের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কিন্তু সত্যিই কি নিরপরাধ মানুষের জীবনে এমনটা ঘটে? মনে হয় না। এই ছবিতে কারাগারে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা শুনে বারো বছর আগের স্মৃতি কতটা নির্মম ভাবে ধরা দেয় মানুষের জীবনে, তা ছবি বিশ্বাস তাঁর অভিনয় সত্তা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে সন্তান ও স্ত্রী হয়তো না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছে। এই যে মর্মস্পর্শী অনুভূতি ও আবেগ— তা কত নিখুঁত ভাবে উনি তুলে ধরেছেন! এক জন কিংবদন্তি অভিনেতা বলেই সম্ভব হয়েছে। অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে ওঁর যে দৃঢ় মানসিক সংযোগ ছিল, তা এক কথায় অতুলনীয়।

ছবি বিশ্বাসের অসামান্য অভিনয় দক্ষতার দলিল হয়ে রয়ে গিয়েছে এই অবিস্মরণীয় সংলাপ। সবার উপরে ছায়াছবিতে এমন দুর্দান্ত অভিনয় বোধ হয় স্বয়ং ছবি বিশ্বাস বলেই সম্ভব হয়েছিল। এক দিকে এক জন উপার্জনশীল ব্যক্তিরূপে ওঁর অভিনয়, আর তার পাশাপাশি অন্য দিকে অপরাধী না হয়েও অপরাধীরূপে বারো বছরের কয়েদি জীবনের অসহনীয় দুর্দশার যে আকুতি দেখিয়ে গিয়েছেন, তা চোখে জল এনে দেয়। আমি এই ছায়াছবিটি ছোট থেকেই স্মৃতিতে লালন করে চলেছি ‘ফিরিয়ে দাও সেই বারোটা বছর’ সংলাপের মধ্যে দিয়ে। প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ও অতুলনীয় মানুষ হিসাবে ছবি বিশ্বাসকে তাঁর ১২৫ বছরের জন্মদিনে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।

স্নেহাশিস সামন্ত, দাশনগর, হাওড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Uttam Kumar Bengali Film Legend

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy