সৌরজিৎ দাসের ‘আমার জল, তোমার জল’ (৭-৫) শীর্ষক প্রবন্ধ অনুযায়ী, হাতে মারার আগেই পাকিস্তানকে ভাতে মারার মধ্য দিয়ে অঘোষিত কৌশলী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সিন্ধু-সহ আলোচ্য নদীগুলির ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। অর্থাৎ ভারত চায়, ক্ষতি ও ক্ষত বুঝে পাকিস্তান বশ্যতা স্বীকার করুক। পশ্চিম এশিয়ায় প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল ও ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতোই ভারত-পাকিস্তান এক দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বলেই আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সিন্ধু নদ ছাড়িয়ে ভারতের উত্তরে হিমালয় অঞ্চলে অন্যান্য নদনদীর উপর প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও কিন্তু দেখা দিতে পারে। লেখক বিচক্ষণতার সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করেছেন।
হিমালয় অঞ্চলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিন, বাংলাদেশের সঙ্গে এখন ভারতের সম্পর্ক ভাল নয়। নেপাল দুর্বল দেশ। যে দিকে পাল্লা ভারী সে দিকে ঝুঁকবে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান আঁতাঁত তৈরি করছে। রাজায়-রাজায় যুদ্ধে তিব্বত বেসামাল। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অসন্তোষ বাড়লে তিব্বত থেকে ভারতে প্রবাহিত নদীজল আটকে গেলে উত্তর ভারত তো বটেই, ক্ষতিগ্রস্ত হবে পশ্চিমবঙ্গও। নদীমাতৃক ভারতের ভাত বা কৃষিনির্ভর অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে বরফগলা জল ও বর্ষার জল থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী জলসেচের উপর, যা অনেকটাই সঞ্চিত হয় ভূ-গর্ভস্থ জল ভান্ডারে। যুদ্ধের এই আবহে ক্ষত যত বাড়বে, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মাত্রা বেড়েই চলবে (‘ক্ষত কত ক্ষতি কত’, অতনু বিশ্বাস, ৭-৫) যেগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধের সম্পর্ক নেই।
যুদ্ধ সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সীমানায় তীব্র হয়। নদীর জল, পাহাড়ের গায়ে বরফ, ভূমির নীচে জলস্তর, বৃষ্টি, সমুদ্রের জল, বায়ুমণ্ডল, সৌরশক্তি ইত্যাদির উপর কাল্পনিক সীমারেখা টেনে সার্বভৌমত্ব দাবি করলেও কোনও রাষ্ট্র প্রাকৃতিক জল, বায়ু, শক্তি ইত্যাদির উপর চূড়ান্ত সীমারেখা টানতে পারে না, দখল নিতে সক্ষম হয় না। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধের সঙ্গে আলোচ্য নদীগুলির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও নদীগুলিকে যান্ত্রিক ভাবে শুকিয়ে বদলা নেওয়া হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে, নদীর ভূমিসংলগ্ন গতিপথ সাধারণত স্থির, কিন্তু প্রবাহিত জল চির-অস্থির, গতিময়। আলোচ্য যুদ্ধে কৌশলগত ভাবে নদীর জল আটকানোর যৌক্তিকতা বিষয়ে প্রশ্ন তুলছি না। কারণ, ভারত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের দায়িত্ব ভারতের প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র দফতরের। তারা অনেক ভাবনাচিন্তা করে যা ভাল বুঝছে তাই করছে। কিন্তু মাঝখান থেকে প্রকৃত যুদ্ধের আগেই যুদ্ধ না করেও মারা পড়ছে নদী।
একটা নদী শুকিয়ে গেলে তার সমগ্র গতিপথে পরিবর্তন আসে। যুদ্ধ মিটে গেলে জল ছাড়লেও পূর্বের অবস্থা ফিরে না আসাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বাঁধে জলধারণ ক্ষমতা, পলিধারণ ক্ষমতা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদির কথাও বিবেচ্য। দীর্ঘদিন ধরে শুকিয়ে গেলে নদীর দু’দিকে সভ্যতার স্থায়ী ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়। দেশ নিরপেক্ষ ভাবে সব দেশের মানুষের চোখে জল উপচে পড়ে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
চেকের অহঙ্কার
‘তামাদি চেক’ (৪-৫) পড়ে মনে হল, বঙ্কিমের ভাষায় বলা যায় “হায় চেক, তোমার দিন ফুরাইয়াছে।” তবে এক সময়ে পারিশ্রমিক বা কাজের মজুরি হিসাবে চেকের অবদান কোনও দিনই ভোলা যাবে না।
৩৫ বছর ব্যাঙ্কে চাকরি করার সুবাদে চেক বইয়ের প্রতি যে এক বিশেষ ভালবাসা গড়ে উঠেছিল তা অস্বীকার করা যায় না। কত রকম বানানে চেকের সংখ্যা লেখা হত, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সেই নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-পরিহাসও চলত। তবে চেকের মাধ্যমে টাকা আদানপ্রদান এক অত্যন্ত নিরাপদ মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হত এবং এখনও হয়। চেকের মাধ্যমে টাকা আদানপ্রদান হলে সেই লেনদেন স্বচ্ছ বলে গ্রাহ্য হত। সুদৃশ্য কলমে, ঝকঝকে হাতের লেখায়, চেকের ভারী কাগজের উপর খসখস করে টাকার পরিমাণ বসানোর মধ্যে যে অহঙ্কার ফুটে উঠত, নব্য পদ্ধতির ‘টুং’ ধ্বনি তার ধারেকাছেও আসে না।
ষাট, সত্তর, আশির দশকের সিনেমায় দেখা যেত, বড়লোক নায়িকার রাশভারী বাবা চেক হাতে গরিব নায়কের উদ্দেশে বলতেন, “কত টাকা পেলে তুমি আমার মেয়েকে ছেড়ে চলে যাবে?” তার পর নায়কের ধীর অচঞ্চল অথচ দৃঢ় স্বরে সেই চেক প্রত্যাখ্যান ছিল প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা।
আজ তা স্মৃতিচারণমাত্র। ডিজিটাল ভারতেও চেকে লেনদেন আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ভারতেও চেক বইয়ের ব্যবহার শেষ হয়ে যাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। চেক ব্যবহারের খরচ ও চেক ভাঙানোয় দীর্ঘ সময় লাগার কারণে চেক বইয়ের উপযোগিতা ক্রমে শূন্য হতে চলেছে। তৎক্ষণাৎ টাকা প্রেরণের মাধ্যম হিসাবে বৈদ্যুতিন লেনদেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে। এই দ্রুতগতির যুগে স্বাভাবিক ভাবেই প্রাচীন পদ্ধতিকে সরিয়ে নতুন মাধ্যম জায়গা করে নেবে।
তবে, একটা বিষাদের সুর সম্পাদকীয় জুড়ে ফুটে উঠেছে যে, এর ফলে মানুষে মানুষে সাক্ষাৎ ও কথার আদানপ্রদান আরও কমে যাবে এবং মানুষ আরও নিঃসঙ্গতার শিকার হয়ে পড়বে।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
অব্যবস্থা
সম্প্রতি একটি আঞ্চলিক বইমেলায় বই কিনতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ঘটনার সম্মুখীন হলাম। গত ২৮ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত মধ্যমগ্রাম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে পৌঁছে কিছু প্রকাশনী সংস্থার কাছে বই কিনতে গিয়ে লক্ষ করলাম, দু’-একটি স্টল বাদে বেশির ভাগ স্টলেই কোনও সিলিং ফ্যান বা কোনও রকম ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে আলোর ব্যবস্থাও। গ্রীষ্মের শুরুতে যেখানে তাপমাত্রা ৩৬-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছিল, সেখানে আয়োজক সংস্থা কী ভাবে এমন একটা বিষয়ে এতটা উদাসীন হলেন? স্টলের ভিতরে থাকা মানুষগুলি গলগল করে ঘামছিলেন। তাঁদের দেখে সত্যিই কষ্ট পেলাম। শুধু তা-ই নয়, স্টলগুলিতে জলের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। অথচ, এত গরমে উদ্যোক্তারা বইমেলার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন দুপুর দুটো থেকে রাত আটটা। ওখানে যে স্টলগুলি হয়েছিল, তার ভিতরে এতটাই গরম যে, যিনি স্টল পরিচালনা করছিলেন, তিনি অনবরত ঘামছিলেন তো বটেই, ওই প্রচণ্ড গরমে কোনও পাঠকও বেশি ক্ষণ স্টলের ভিতর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। বই পড়া বা বই নিয়ে নাড়াচড়া করা তো অনেক দূরের কথা!
শুধু তা-ই নয়, বাইরে থেকে ভেসে আসছিল ওই মাঠেই অনুষ্ঠানের জোরালো মাইকের আওয়াজ। এই জোরালো আওয়াজকে সঙ্গী করে বইপ্রেমীরা শান্ত স্নিগ্ধ মনে কী ভাবে বইচর্চা করতে পারছিলেন, তা নিয়েও আমার সংশয় আছে। আর একগাদা ফুড স্টল আর রকমারি অন্যান্য জিনিসপত্রের স্টলের মাঝে বইয়ের স্টলগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, খাদ্যমেলার মাঝে হয়তো এসে পড়েছি, এটা বইমেলা নয়।
ওঁদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ওই ক’দিন স্টল দেওয়ার জন্য প্রত্যেক স্টল থেকেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়েছে কমিটির তরফ থেকে। প্রশ্নটা স্বভাবতই মনে আসে, তার পরেও বইমেলা পরিচালনা করতে গিয়ে এ-হেন ঔদাসীন্য কেন? কেনই বা স্টলগুলিকে এতটুকু সহযোগিতা করা হল না? কোথাও সামান্য জলটুকুও রাখা গেল না!
এই ভাবে বইমেলা করে আদৌ কি বইপ্রেমীদের মন জয় করা যাবে? এত গরমে শুধু বইমেলা আয়োজন করে দিয়েই দায়িত্ব সারতে পারল কী ভাবে আয়োজক কমিটি? মানবিকতা থেকেও কি এতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা যেত না?
রতন কুমার দাস, বেলডাঙা, মুর্শিদাবাদ
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)