Advertisement
E-Paper

ভোট করানোর কাজে গিয়ে দেখা হয়ে যায় ভারতের সঙ্গে

নির্বাচনের কাজে মোটে এক-দেড় দিনের পরিচয়। মধ্যে অসন্তোষ, চেঁচামেচি। তবু অদ্ভুত মিলনসুরে বাঁধা পড়ে যায় অচেনা মুখগুলো। লিখছেন শৌভিক রায়ভারতের সাধারণ নির্বাচন এমনই এক ঘটনা, যাকে ঘিরে বিবিধের মাঝে মহান মিলনের সুরটি শোনা যায়। শুধু  কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই জওয়ানেরাই নন, এই মিলনে সামিল নানা বর্ণের, নানা জাতের, নানা ভাষার মানুষ, যাঁদের একটাই পরিচয় যে, তাঁরা ভারতীয়।

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৭:০৫

প্রথম পর্বের নির্বাচন শেষ উত্তরবঙ্গে। চোখে ভাসছে সুঠাম শরীরের কৃষ্ণকায় দ্রাবিড় জওয়ানটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সা লম্বা জাঠ তরুণটিকে। মনে পড়ছে এই দু’জনের সঙ্গী সদাহাস্যময় মালয়ালি বা ঝকঝকে চেহারার বাঙালি যুবকদ্বয়কেও। ভোটিং মেশিন সিল করে আর কাগজপত্র গুটিয়ে বিদায়ের সময় ওঁরা যখন কার্যত সমস্বরে বলে উঠলেন— ‘আপকো বহুত মিস করেঙ্গে’, তখন সত্যিই আত্মীয়-বিদায়ের ব্যথা বেজে উঠল বুকে। অথচ, ওঁদের সঙ্গে পরিচয়ের সময়সীমা ২৪ ঘণ্টার খানিক বেশি।

ভারতের সাধারণ নির্বাচন এমনই এক ঘটনা, যাকে ঘিরে বিবিধের মাঝে মহান মিলনের সুরটি শোনা যায়। শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই জওয়ানেরাই নন, এই মিলনে সামিল নানা বর্ণের, নানা জাতের, নানা ভাষার মানুষ, যাঁদের একটাই পরিচয় যে, তাঁরা ভারতীয়। তাই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এক প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও এক রাজনৈতিক দলের বুথকর্মী মাঝবয়সি ইব্রাহিম খন্দকারের সলাজ হাসি মিশে যায় আমাদের ভোটকর্মীদের বিদায়বেলার হাসির সঙ্গে। অদ্ভুত একাত্মতা বোধ করেন সকলেই বোধ হয় আর সেই জন্যই অন্য শিবিরের বুথকর্মী সুবল বর্মণ বা পরিমল সরকারের সঙ্গে ইব্রাহিম সাহস করে বলে ফেলেন— ‘‘অবসর করি আসিয়া গ্রামখানা একবার ঘুরিয়া যান।’’ রাজনৈতিক ভেদাভেদ মুছে গিয়ে আবার শোনা যায় মিলনের সুর।

এ সুর ভুলিয়ে দেয়, কে কোন পদাধিকারী। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সকলের লক্ষ্য এক আর সে লক্ষ্য হল দেশের সম্মান। ভোটসামগ্রী নিয়ে নির্বাচনী কেন্দ্রে যাওয়া নানাবিধ চাকরিজীবীর সঙ্গে তাই অনায়াসে মিশে যান তাঁদের নিয়ে চলা যানটির চালক ও সহকারী। গুরুগম্ভীর সরকারি চাকুরেরা দিব্যি হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেন তাঁদের সঙ্গে। মনে হতে পারে যে, কর্তব্যের তাগিদে গড়ে ওঠা এই সখ্যের মূল্য আর কী! কিন্তু এখানেই বাজিমাত নির্বাচনের! সামান্য পরিচয়েই অনেকবার দেখেছি, সেই চালক বা তাঁর সহকারী ভোটকেন্দ্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভোটকর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। শুধুমাত্র কর্তব্যের তাগিদে এ ভাবে কারও পাশে দাঁড়ানো যায় না। মনের তাগিদে, মানবিকতার তাগিদে তাঁদের এই সমর্থন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে, নির্বাচন সবাইকে মিলিয়ে দেয়।

নির্বাচন ক্ষেত্রে বাসিন্দাদের তাগিদই-বা কীসের কম? সেল্‌ফ-হেল্‌প গ্রুপের সদস্য হিসেবে ভোটকর্মীদের খাওয়ানোর পাশাপাশি তাঁদেরকে স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার দায়িত্বও স্বেচ্ছায় তুলে নেন তাঁরা। হয়তো প্রিসাইডিং অফিসারের পান খাওয়ার অভ্যেস। সেল্‌ফ-হেল্‌প গ্রুপের সদস্য ছুটে গেলেন বাড়ি থেকে পান সেজে আনতে। কখনও আবার ভোটের দিন ব্যস্ত অফিসারকে তাঁরা নিজে থেকেই দু`বার পান দিয়ে গেলেন। এ সবের হিসেব কি টাকায় পূরণ করা যায়? না কি হিসেব করা উচিত? বহুবার ভোট করতে গিয়ে নানা অপ্রত্যাশিত ব্যবহারের সামনাসামনি হয়েও মনে রাখতে পারিনি সে সব অভিজ্ঞতা। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, মে মাসের কাঠফাটা গরমে টিনের তপ্ত চালের নীচে বসে দরদর করে ঘামতে থাকা এই ভোটকর্মীর জন্য সুদেব মণ্ডল পাখা এনে দিয়েছিলেন না চাইতেই! এ রকম কত টুকরো টুকরো ছবি মনে পড়ে যায় ভোটের কাজে এলে! আর সেই টুকরো টুকরো ছবি এক ফ্রেমে যদি গেঁথে ফেলি, তবে সত্যিই মানবজীবনের এক অনন্য যাপনচিত্র পাই!

ভোটের পরিভাষায় যাকে ‘সেক্টর’ বলে, সেই কর্মীদের কথা ভাবা যাক। ভোট ঠিকঠাক হওয়ার গুরুদায়িত্বই নয় শুধু, ভোটকর্মীদের নিরাপত্তা, ভোটের শেষে তাঁদের রিসিভিং সেন্টারে (যা আগের দিন ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার ছিল) পৌঁছে দেওয়ার কাজও তাঁদের। ভোটকেন্দ্রে পৌঁছনো ইস্তক তাঁরা আগের দিন থেকে কয়েকবার ভোটকর্মীদের দেখে গিয়েছেন ভোটকেন্দ্রে এসে। বিভিন্ন অসুবিধার কথা শুনেছেন, সমাধানের চেষ্টা করেছেন, পেরেছেন অথবা পারেননি। পারুন না-পারুন, আমরা নির্বিবাদে তাঁদের তুলোধুনো করেছি। নীরবে কেউ কেউ সে সব হজম করেছেন, কেউ আবার উল্টে আমাদের বলেছেন। এই দ্বৈরথের মধ্যে ভোট হয়েও গিয়েছে। সেক্টরের কর্মীরা আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, আমরা ধন্যবাদ দিয়েছি। কখনও রাগে গজগজ করতে করতে সেক্টরের লোকেদের সঙ্গে কথা না বলে অভিমানে আমরাও যেমন মুখ ফিরিয়ে রেখেছি, ওঁরাও সে ভাবেই জবাব দিয়েছেন। এই মান-অভিমানের পর্ব মিটেও যায়। আসলে, কে না জানে, মান-অভিমান খুব ঘনিষ্টজনের মধ্যেই হয়। সেক্টর-কর্মী ও নির্বাচনী কেন্দ্রে থাকা কর্মী— দু’পক্ষই জানেন যে, তাঁরা একে অপরের পরিপূরক। কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারবেন না। অর্থাৎ, এখানেও নির্বাচনের সেই মিলিয়ে দেওয়া!

গতদিন যে কর্মীরা ভোটসামগ্রী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, প্রায় নিদ্রাহীন থেকে তাঁরাই নির্বাচনের শেষে সে সব গ্রহণ করেন। সরকারি আমলারা ঠান্ডা ঘরে বসে নানা উদ্ভাবন করেন আর সে সব বাস্তবায়নের দায়িত্ব চাপে তাঁদের উপর। দু’দিন ধরে নির্বাচনের ধকল সামলে ভোটকর্মীরা শারীরিক ভাবে তখন বিধ্বস্ত। তাই নব নব উদ্ভাবন শুনলেই রেগে আগুন সকলে। শুরু করে দিই চেঁচামেচি। বুঝি, ওঁদেরও কিছু করার নেই! আমাদের মতোই দশা ওঁদের! অগত্যা বিরোধ এড়াতে গজগজ করতে করতে নতুন নির্দেশিকায় কাজ করা। এতে ওঁরাও বাঁচেন, আমরাও মুক্ত হই। ছাড়া পেয়ে মুক্তির আনন্দে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে— ‘দিদি, ধন্যবাদ!’ আর তা শুনেই এক গাল হেসে ফেলেন তিনি। কে বলবে, একটু আগেই তাঁর সঙ্গে তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি চলছিল! ‘খুব যে কষ্ট হয় আপনাদের, বুঝি! আসলে...!’ এটুকু শুনেই আমরাও এক গাল হেসে কষ্টগুলো মন থেকে মুছে ফেলি!

এর পর আসে আমাদের আলাদা হওয়ার সময়। ‘আমরা’ বলতে, যে দল গিয়েছিলাম ভোট নিতে। প্রতিবার নতুন নতুন ব্যক্তি নিয়ে গঠিত দলের সকলেই কখন যেন এক হয়ে যাই! কোনও এক অদৃশ্য সুতো আমাদের বেঁধে রাখে দৃঢ় ভাবে। পারস্পরিক শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ শেষ হলে যোগাযোগ রাখার অঙ্গীকার নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়াও কখনও কখনও গাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হয়ে যায়!

সাধারণ নির্বাচন তাই আমার মতো ভোটকর্মীদের কাছে কর্তব্য আর মিলনের শ্রেণি-সম্প্রদায়হীন এক সর্বজনীন মহোৎসব!

(লেখক কোচবিহার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Lok Sabha Election 2019 Election Duty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy