Advertisement
E-Paper

এর পরও কি মানতে হবে, ভোটারদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত?

তৃতীয় দফাতেই প্রাণহানি। আরও এক বার রাজ্যে রক্তাক্ত হল নির্বাচন। নির্মম সংখ্যার বিচারে ‘মাত্র’ একটি মৃত্যু হয়তো বিরাট কোনও আলোড়ন তুলবে না। এই হত্যা রাজনৈতিক, পারিবারিক, না কি গ্রাম্য বিবাদের ফল

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:১৮
নাগরিক? তৃতীয় পর্বের ভোট চলাকালীন নিহত কংগ্রেস কর্মীর পরিজনবর্গ, ভগবানগোলা, মুর্শিদাবাদ, ২৩ এপ্রিল। পিটিআই

নাগরিক? তৃতীয় পর্বের ভোট চলাকালীন নিহত কংগ্রেস কর্মীর পরিজনবর্গ, ভগবানগোলা, মুর্শিদাবাদ, ২৩ এপ্রিল। পিটিআই

তৃতীয় দফাতেই প্রাণহানি। আরও এক বার রাজ্যে রক্তাক্ত হল নির্বাচন। নির্মম সংখ্যার বিচারে ‘মাত্র’ একটি মৃত্যু হয়তো বিরাট কোনও আলোড়ন তুলবে না। এই হত্যা রাজনৈতিক, পারিবারিক, না কি গ্রাম্য বিবাদের ফল— তা নিয়ে টানাপড়েনও হয়তো অল্পেই থিতিয়ে যাবে। কিন্তু গণতন্ত্রের মহোৎসবে অংশ নিতে বেরিয়ে যিনি আর বাড়ি ফিরতে পারলেন না, রাস্তার পাশে কুপিয়ে মেরে ফেলা হল যাঁকে, তাঁর প্রাণহীন দেহ কি আমাদের বিবেকের কাছে জবাবদিহি চাইবে না?

তিনি কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট, তৃণমূল বা বিজেপি সেই তর্ক তুলে রাজনীতিকেরা দায় এড়াতে পারেন। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ইত্যাদি সিলমোহরধারীরা ঘটনাটি ভোট কেন্দ্রের কত ফুট, কত ইঞ্চি দূরে ঘটেছে, সেই হিসাব কষে নিজেদের দায়িত্বের চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ করতে পারেন। কিন্তু সবাই মিলে একবাক্যে কেউ বলবেন না, ‘‘এ আমার, এ তোমার পাপ!’’ বলবেন না, কারণ সেটা বলার হিম্মত এঁদের কারও নেই।

কেন এ কথা বলতে হচ্ছে? সেই বিষয়ে আলোচনার আগে এই রাজ্যের ‘ভোট-ঐতিহ্য’-এর দিকে একটু ফিরে তাকানো প্রাসঙ্গিক।

দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে বাহুবলের ভোট, জালিয়াতির ভোট যেন নির্বাচনপ্রক্রিয়ারই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আরও আক্ষেপের হল, যে সব রাজ্যের মাথায় বিশেষ করে এই কলঙ্কের মুকুট পরানো, এই রাজ্য সেই তালিকায় বহু আগেই নাম লিখিয়েছে।

রাজ্যের বর্তমান শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট-সন্ত্রাসের অভিযোগ এখন জলভাত। সেগুলি সবই অসার, তা-ও নয়। বস্তুত গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই রকম বহু অবাঞ্ছিত ঘটনার স্মৃতি এখন লোকসভা ভোটের বাজারেও দলকে তাড়া করছে। নিজের ভোট নিজে দিতে না-পারার ক্ষোভ এর আগেও চরম আকার নিয়েছিল সল্টলেকের পুরনির্বাচনে। সেই সব সত্য চাইলেই ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না।

কিন্তু তৃণমূলের আট বছর রাজত্বের আগে এখানে ভোট হত না, তা তো নয়। আর তখন যে কী হত, সেই অভিজ্ঞতাও সহজে ভুলে যাওয়ার নয়। ভোটে ক্ষমতার অপব্যবহার, বাহুবল ও অর্থবল-সহ সর্বরকম অবৈধতাকে এই রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় পরিপুষ্ট করার অন্যতম কৃতিত্ব সিপিএমের। বুথ দখল, রিগিং, ছাপ্পা ভোট, বোমা-গুলি, ভোটার খেদানো, ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করা ইত্যাদিকে আক্ষরিক অর্থে নিপুণ শিল্পে পরিণত করতে পেরেছিল তারা।

তারও আগে রাজ্যে বাহাত্তর সালের ভোটে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধেও ‘ভোট-সন্ত্রাস’-এর গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। বাহুবলে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট তখন তাদের ক্ষমতা দখলকে ‘কালিমালিপ্ত’ করে। বাম নেতারা এখনও উঠতে-বসতে সেই উদাহরণ দেন। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে ওই নির্বাচন নিয়ে বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশনও করেছিল। রিপোর্ট অবশ্য আলোর

মুখ দেখেনি। এবং এখন রাজ্যে যা হচ্ছে, তা কংগ্রেস ও বামেদের দেখানো-শেখানো কৃৎকৌশলেরই পরম্পরা।

কিন্তু সে যা-ই হোক, আয়নায় নিজের কালো মুখ কেউই দেখতে পছন্দ করেন না। তাই অতীতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস, সিপিএম থেকে এখনকার তৃণমূল, সকলেরই দাবি: তারা ‘সুষ্ঠু, অবাধ’ নির্বাচনে আস্থাশীল। জুলুমের ভোট তারা করে না!

এ তো গেল ভোট-সংস্কৃতির একটি দিক। অন্য দিকে আছে নির্বাচন কমিশন। আছে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের প্রশ্নে চিরাচরিত রাজনৈতিক বিবাদ। এ বার এই লোকসভা ভোটে তা কতটা চরম আকার নিয়েছে, সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি, রাজ্যে যে ভাবে বেছে বেছে বিভিন্ন স্তরের পুলিশ অফিসারদের বদলি করা হল, তার পিছনেও ‘অঙ্গুলিহেলন’ ছিল কি না, সেই প্রশ্ন নিয়ে ভাবার অবকাশ থেকে যায়।

তা সত্ত্বেও দেশের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ যখন নিজেদের ‘স্বাধীন, নিরপেক্ষ’ ভাবমূর্তি সামনে রেখে নির্বিঘ্ন ভোট করানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন, তখন তাতে আস্থা না রাখার কারণ ছিল না। সত্যি বলতে কী, বিকল্পই বা কোথায়! অতএব প্রথম দু’দফার ভোট মোটামুটি রক্তপাতহীন হওয়ার পরেও তাঁরা যখন জানালেন, তৃতীয় দফায় ৯২ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হবে, তখন ‘ভরসা’র মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

কিন্তু দুর্ভাগ্য-লিখন বদলাল কই! কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যা বাড়ল যখন, তখনই মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় ভোটকেন্দ্রের কয়েক হাতের মধ্যে কুপিয়ে দেওয়া হল বৃদ্ধ টিয়ারুল শেখকে। তিনি মারা গেলেন। ঘটনাস্থলের কাছেই বুথ পাহারায় ছিলেন বিএসএফের তিন জওয়ান।

নিহত বৃদ্ধ কোন দলের সমর্থক, তাঁকে কোন দলের লোকেরা মেরেছে— সেই ক্লিন্ন কোন্দল যারা করছে, করুক। তিনি রাজনীতির বলি, না কি অন্য বিবাদের, সেই সব নিয়েও পার্টিবাজেরা মনের সুখে গলা ফাটাতে পারেন। কারণ আগেই বলেছি, রাজনীতিকদের দায় এড়ানোর বা দায় চাপানোর দায় আছে। তাতে সাধারণ মানুষের কিছু আসে যায় না। প্রশ্ন এবং বিস্ময় অন্যত্র।

ঘটনাস্থলের যে বিবরণ মিলেছে, তাতে জানা যায়, বৃদ্ধ ভদ্রলোক প্রথম আক্রান্ত হন বুথের ৪০ মিটারের মধ্যে। তখন সেখানে ভোটারদের লাইন। তাঁকে হাঁসুয়া দিয়ে পেটে আঘাত করার পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি বসে পড়েন বুথের লাগোয়া একটি দেওয়ালের ধারে। তার পর প্রাণভয়ে দৌড়তে থাকেন। পিছনে তাড়া করে ঘাতকেরা। কিছুটা এগিয়ে আবার আঘাত। তিনি পড়ে যান।

গোটা ঘটনাটি যখন ঘটছে তখন বুথের পাহারায় উপস্থিত বিএসএফের জওয়ানেরা কেউ এগিয়ে এসেছিলেন বলে খবর নেই। বরং যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কাজ বুথে ইভিএম সামলানো। এর চেয়ে অধিক হৃদয়হীনতা আর কী হতে পারে,

তা ভেবে শিউরে উঠতে হয়। বুথের ধারে কাছে রাস্তায় অন্য কোথাও রাজ্যের কোনও পুলিশ ছিল না কেন, থাকলে তারাই বা কী করল, সেটা ভাবলেও অবাক লাগে।

এই আক্রমণ রাজনৈতিক কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর পিছনে ভোট বানচাল করার মতো বড় ছক যে ছিল না, সেটা কিছুটা স্পষ্ট। কারণ হামলাকারীরা নির্দিষ্ট ভাবে এক জনকেই মেরেছে। বুথের ভিতরে ঢোকার বা ভোটের লাইন ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা হয়নি। বুথে ভোটও তাই বন্ধ হয়নি।

এখন প্রশ্ন, ভোটের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মীদের কাজ কী? কেন্দ্রীয় বাহিনী কতটা এলাকা সামলাবে? রাজ্যের পুলিশই বা কী দায়িত্ব পালন করবে? দ্বিতীয়ত, এক জন মানুষের উপর প্রাণঘাতী হামলা হচ্ছে দেখে বা বুঝেও নাগরিকদের (এ ক্ষেত্রে ভোটার) সুরক্ষায় ব্রতী উর্দিধারীরা ক্লীব হয়ে থাকলে তাঁদের মোতায়েন করার এই নাটক করা হয় কেন? তৃতীয় প্রশ্ন, এই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতির যুক্তি দিয়ে কমিশনের যে সব আধিকারিক এখানে অধিক সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে যাচ্ছেন, বাহিনীর নাকের ডগায় এমন মর্মান্তিক খুনের ঘটনার পরে তাঁরা অপদার্থতার দায় নেবেন না কেন?

নির্বাচন দফতরে পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানুষটির মৃত্যু হয়েছে বুথ থেকে ১০০ মিটার দূরে। অর্থাৎ সেটা ভোটবাহিনীর সীমানার বাইরে বলা যেতে পারে। কিন্তু আক্রমণ যে বুথের ৪০ মিটারের মধ্যে হয়েছে, সেই সত্যের মুখোমুখি হতে এঁরা চাননি। বলা ভাল, সাহস পাননি।

এই হৃদয়হীনতা আমাদের স্তম্ভিত করে! গজ-ফুট-ইঞ্চি মেপে যাঁরা নিজেদের পিঠ বাঁচানোর পথ খোঁজেন, তাঁরা নাকি ভোটারদের ‘সুরক্ষা’র জিম্মাদার! তাঁরাই নাকি গণতন্ত্রের এই মহাপূজার এক এক জন পুরোহিত!

আরও চার দফা ভোট বাকি। আরও পথ পেরোতে হবে। সেই পথের বাঁকে ‘গণতন্ত্র’ কোন রূপে অপেক্ষা করছে, কে জানে!

Politics Lok Sabha Election 2019 Vote Violence Political Violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy