বিরোধী পক্ষের প্রার্থী পুনর্নির্বাচনের দাবিতে সরব। কিন্তু না, এইটুকু শুনে আসল খবরটা বুঝব না আমরা। আসল খবর হল, যিনি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে হইচই ফেললেন, গত পঞ্চায়েত ভোটে কিন্তু তিনি ক্ষমতাসীন দলেই ছিলেন। যে-সব ভয়ানক অন্যায়ের অপবাদ দিয়ে তিনি এ বার সরকার পক্ষকে খুব এক হাত নিয়েছেন বলে শোনা গেল, সেই অপবাদগুলি নাকি গত বারের ভোটে স্বয়ং তাঁরই ভূষণ ছিল!
ভোটদাতা জনগণের হয়েছে মুশকিল। তাদের বহু কষ্টে প্রয়োগ করা অধিকারের ফলটি নিয়ে প্রার্থীরা কবে যে কোথায় চলে যাবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উপায় জনগণের হাতে নেই। সে ক্ষেত্রে তাদের মতামতের আর কোনও গুরুত্ব থাকে কি? শুধু তা-ই নয়, দলবদলের পর সেই সাংসদ বা বিধায়কের সদস্য পদ খারিজের একমাত্র অধিকার থাকল সংসদ বা বিধানসভার স্পিকারের কাছে। এ দিকে স্পিকার পদটি যে হেতু নির্বাচনে জয়ী শাসক দলের দ্বারা নির্ধারিত হয়, কাজেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই দলের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি কারও ক্ষতি করতে চান না।
অতএব কিংকর্তব্যম্? যে দলকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ‘সাম্প্রদায়িক’ ভেবে জনগণ বাতিল করল এবং তার বিরোধী দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জেতাল, সেই জয়ী সদস্যই যদি অদূর ভবিষ্যতে সেই ‘ফ্যাসিস্ট’ কিংবা ‘সাম্প্রদায়িক’ দলের মন্ত্রী হয়ে বসেন, তবে জনগণের বিমূঢ় হয়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আগের বার যাদের তুলোধোনা করেছেন, এ বারের ভাষণে নেতারা তাদেরই জয়গান করেন। এতটা বিভ্রান্তিই গণতন্ত্রের লক্ষণ কি না কে জানে।
যে দেশে সংস্কৃতিমনস্ক কৃতী জনগণের অভাব নেই, সেখানে আইনসভার সদস্য হতে গেলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত করা নেই কেন? মেনে নেওয়া গেল যে, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ঠিক প্রথাগত শিক্ষাগত যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না। কিন্তু শিক্ষা যে মানবসম্পদের গুণগত মান সামান্য হলেও বাড়িয়ে দেয়— এইটুকু তো অস্বীকার করা চলে না। অবশ্য দুর্ভাগ্য এই যে, এ দেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের মন্ত্রীকেও তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করতে হয়। কেননা অচিরেই জানা যায়, তিনি প্রকৃত অর্থে উচ্চশিক্ষিতই নন, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও কালে পদার্পণ করেননি। (না, রবীন্দ্রনাথের উদাহরণটা এ ক্ষেত্রে গ্রাহ্য হবে না।) তবে ঠিকই, এই ক্ষেত্রে দোষ হয়তো প্রাক্তন মন্ত্রীর নয়। দোষ আমাদের গণতন্ত্র-বিধির। কাজেই, জনস্বার্থ বিঘ্নিত হলেও গণতন্ত্রকে চুপ থাকতে হবে।
বিষয়গুলি কি আর এক বার ভেবে দেখা যায় না? গণতন্ত্রকে স্বাস্থ্যবান করে তুলতে শুধু ভোটের হার বাড়ানোকেই লক্ষ্য না করে জনপ্রতিনিধিদের প্রার্থিপদ বিচারের ক্ষেত্রে আরও কড়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হোক দলগুলিকে। প্রার্থীর দলবদলের বিষয়টিও নতুন করে বিচার হোক। ব্যক্তিস্বার্থে হোক বা নীতিগত কারণে— কোনও ভাবেই কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সারা জীবনে তিন বারের বেশি দলবদল করতে পারবেন না, এমন একটি নীতি থাকলে ভাল হয়। এক দলের চিহ্ন নিয়ে ভোটে জিতে এসে অন্য দলের চিহ্নে ঢুকে যেতে পারবেন না কোনও প্রার্থী, তাঁকে অন্তত পরের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ভোটে কেউ নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে জিতলে জেতার পর কোনও রাজনৈতিক দলে তিনি যোগ দিতে পারবেন না।
গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা এবং সংবেদনশীলতা রক্ষা করতে আর একটা আইন প্রবর্তনও জরুরি কি না, এক বার ভেবে দেখলে ভাল হত। কোনও রাজনৈতিক দল ভোটে জেতার পরে বিরোধী বা অন্য দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারবে না— নীতিগত ভাবে জোট হলে তা হোক ভোটের আগেই। গণতন্ত্রে বাস করা জনগণ যেন নীতিটি চাক্ষুষ করে তবেই ভোট দিতে পারেন। কে কার অথবা কিসের পক্ষে, এটা জেনেই কি আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করা উচিত নয়? নইলে যত দিন এগোবে, ততই আরও বেশি করে জনগণ পরিণত হবে নিধিরাম সর্দারে, আর ভোট পরিণত হবে প্রহসনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy