Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ভয় হয় আমাদের অন্যায় মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে

অসত্যযুগের ভারত

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়তো সেই অংশ, যেখানে তিনি আলোচনা করছেন স্বৈরাচারী শাসককুল নয়, তাদের প্রজাদের অর্থাৎ সেই সমাজের সাধারণ নাগরিকদের কথা।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ০০:০৮
Share: Save:

দার্শনিক হান্না আরেন্ট ছিলেন জার্মান ইহুদি। হিটলারের জমানায় অল্প দিন কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, অন্য ভাবেও আক্রান্ত হয়েছিলেন; ভাগ্যক্রমে আমেরিকা পৌঁছে বাকি জীবন সেখানে কাটান। নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ফাসিস্ত স্বৈরাচারের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাঁর চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়তো সেই অংশ, যেখানে তিনি আলোচনা করছেন স্বৈরাচারী শাসককুল নয়, তাদের প্রজাদের অর্থাৎ সেই সমাজের সাধারণ নাগরিকদের কথা। তাঁর দু’টি বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, ভাবলে ভুল হবে যে সেই সমাজের সকলে, এমনকি শাসকগোষ্ঠীর মেজো-সেজো কর্তারাও, ঘোরতর পাপিষ্ঠ অমানুষ। তাদের আসল অবস্থান হয়তো আরও ভীতিপ্রদ— অধিকাংশই আপাত ভাবে সহজ স্বাভাবিক মনস্ক, অন্যায় বিদ্বেষ অমানবিকতা সবই সহজ ভাবে মেনে নেয়, মনে কোনও দাগ পড়ে না। পাপ-অমঙ্গল তাদের কাছে অভ্যস্ত মামুলি ব্যাপার। বেশির ভাগ লোকের মানসিকতা এই পর্যায়ে না পৌঁছলে মুষ্টিমেয় দাগি স্বৈরাচারী তাদের রাজত্ব কায়েম করতেই পারত না।

দ্বিতীয় লক্ষণটা আরও মোক্ষম, সমস্যার আরও মূলে। এমন সমাজে মানুষ সত্যাসত্য, তথ্য-কল্পনার ভেদাভেদ ভুলে যান। যা শোনেন— বা যা শুনতে চান, শোনার প্রত্যাশা করেন— সেটাই মেনে নেন। বিচারবোধ দূরে থাক, বাস্তববোধ, এমনকি সৎ বিশ্বাসও লোপ পায়। লোকে বাস করে উচ্চগ্রামের বহুশ্রুত কিছু বুলি আর আবেগের নেশার ঘোরে।

হিটলার-মুসোলিনির দিন গত হয়েছে; চরম আক্ষেপ ও বিপদের বিষয়, তাদের তত্ত্ব-দর্শনের হয়নি। বরং তার অন্তরালে আরেন্ট-বর্ণিত এই মৌলিক প্রবণতাগুলি ট্রাম্প সাহেবের আমেরিকা থেকে শুরু করে আরও আরও মুলুকে দিন-দিন ছড়িয়ে পড়ছে। মিথ্যা, ভ্রান্তি, ধোঁকা, আজগুবি, কোনও শব্দই যেন অবস্থাটা বোঝাতে জুতসই নয়। তাত্ত্বিকরা একটা জমকালো নাম দিয়েছেন— পোস্ট-ট্রুথ, উত্তর-সত্য। সতাসত্য যা-ই হোক, এটা কিন্তু পরম বাস্তব, এই আবহেই আমরা বাস করছি। মুশকিল একটাই— একই বাস্তব আমাদের শেখায়, সত্যমিথ্যা ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদগুলো একাকার করে দিলে জীবন বিপর্যস্ত হয়, সুখ শান্তি সমৃদ্ধি কিছুই বজায় থাকে না।

আমরা ভারতবাসীরা আজ ঠিক করতে ব্যস্ত, আগামী পাঁচ বছর আমাদের জীবন কী ভাবে কাটবে। দোর্দণ্ড রাষ্ট্রশক্তিকে কতটা অধিকার দেব আমাদের ব্যক্তিজীবন সমাজজীবন করায়ত্ত করতে। চিন্তার স্বাধীনতা, কথার স্বাধীনতা, এ-সবের গভীরে অবাধ আত্মপ্রকাশের যে স্বাধীনতায় নাগরিক হিসাবে, কী নিছক মানুষ হিসাবেই, বেঁচে থাকার সার্থকতা, তাতে কতটা হস্তক্ষেপ করতে দেব। হিসাবটা আপাতত পাঁচ বছরের বটে, তার জের দীর্ঘমেয়াদি, এমনকি চিরস্থায়ী হবে কি না, সেটাই কিন্তু আসল প্রশ্ন।

সত্য-মিথ্যার ব্যাপারটা আগে দেখা যাক, কারণ সেটা হওয়া উচিত নৈর্ব্যক্তিক। দেখা যাচ্ছে জাতির জনকেরও রেহাই নেই। ইতিহাস বলে, মহাত্মা গাঁধী আজীবন দেশভাগের ঘোর বিরোধী ছিলেন; স্বাধীনতাপূর্বের শেষ পর্বে জাতীয় রাজনীতি থেকে তাঁর অনেকটা দূরে সরে যাওয়ার এটাই বৃহত্তম কারণ। অথচ আজ জোর গলায় প্রচার হচ্ছে, তাঁর অপরাধেই উপমহাদেশের একটা বড় অংশ সংখ্যাগুরুর হাতছাড়া হয়ে গেল। নেহরু রাজনীতি করতেন, তাঁর কথা ছেড়ে দিলাম; কয়েকটা বিচ্ছিন্ন এমনকি মনগড়া বাক্যের ভিত্তিতে বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের বাণীর চরম বিকৃতি ও অপপ্রয়োগ ঘটছে। এমন অবস্থায় জীবিত কুশীলবরা ছাড় পাবেন তা অসম্ভব। এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও এক প্রাক্তন সেনাপ্রধান ষড় করে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, এমন বিস্ময়কর দাবি থেকে শুরু করে অসংখ্য চক্রান্তের কাহিনি ফাঁদা হয়েছে ও হচ্ছে, ব্যক্তিগত কুৎসার কথা ছেড়েই দিলাম। সেখান থেকে ধাপে ধাপে নেমে আসছে স্থানীয় স্তরে উত্তেজক রটনা, নকল ছবি আর তথ্যবিকৃতির রমরমা। অসত্য আর অর্ধসত্যের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে নিছক অসত্য-অর্ধসত্যের চেয়ে ভয়ঙ্কর এক অতিসরল কুযুক্তি আর অপব্যাখ্যার অবতারণা ঘটছে— ‘যদি তুমি রাতের বেলা রাস্তায় বেরোও তো তুমি নিশ্চয় চোর’ গোছের। ক্রমে সকাল-দুপুরও মাঝরাত হয়ে যায়, অভিযোগটা চুরি ছাড়িয়ে গণহত্যায় পৌঁছয়, অভিযুক্তের অভাব হয় না।

অসত্য প্রচারের অভিনব হাতিয়ার আজ সহজলভ্য। এই নির্বাচনে, ও সাধারণ ভাবে আমাদের রাজনৈতিক জীবনে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমের অপব্যবহার বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ কাজে নিযুক্ত হয়েছে দেশবিদেশের বিরাট বাহিনী; মিথ্যা সংবাদ শনাক্ত করতে নেমে সত্যসন্ধানী প্রযুক্তিবিদরা থই পাচ্ছেন না। প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের তুলনায় সামাজিক মাধ্যমে বার্তা ছড়ায় সহস্রগুণ দ্রুত; তার জন্য নির্দিষ্ট কাউকে দায়বদ্ধ করা দুষ্কর; প্রায় নিখরচায় তাকে ছবি-গান-গল্পে আকর্ষক করে তোলা যায়। আর সেই বার্তার উৎস যদি সাগর পেরিয়েও হয়, স্মার্টফোনের দৌলতে তা চলে আসে আমাদের একান্ত এক্তিয়ারে, আক্ষরিক অর্থে হাতের মুঠোয়। তাতে আমাদের আত্মপ্রসাদ হয়, আস্থা জন্মায় আপনাআপনি, বিচারবুদ্ধির প্রশ্ন ওঠে না। চণ্ডীমণ্ডপের পরচর্চা, হেঁশেলের ফিসফাস, চায়ের দোকানে রাজা-উজির বধ— সামাজিক মাধ্যম এ-সবের বিশ্বায়িত রাজসংস্করণ। আমাদের মতো করে, আমাদের মন জুগিয়ে পরিবেশিত এই বার্তার এমনই গ্রহণযোগ্যতা যে বিশ্বাসযোগ্যতা অবান্তর হয়ে পড়ে।

তবে বিশ্বাসের ঠাট একটা রাখতে হয় বইকি। সেটা সম্ভব হয় দুটো কারণে। আমাদের রাজনীতিক শ্রেণি এত সার্বিক ভাবে আমাদের আস্থা হারিয়েছে যে কোনও অভিযোগ কোনও কেচ্ছাকাহিনিই অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিতে মন সরে না। স্বীকার করতেই হয়, প্রবঞ্চনা জবরদস্তি ক্ষমতার আস্ফালন বিরোধী কণ্ঠরোধ ইত্যাদি স্বৈরাচারের লক্ষণগুলি কোনও দলের একচেটিয়া নয়, ক্ষেত্র অনুসারে তারতম্য ঘটে মাত্র। যে বাক্যবর্ষণে আমরা একশা হয়ে আছি, তাতেও প্রত্যেক দলের কমবেশি অবদান, এ কলা দেখায় তো ও ভেংচি কাটে। সংবাদের বড় অংশ জুড়ে থাকে তার মুখরোচক বিবরণ, আমাদের রসনা তৃপ্ত করে।

করে তা বেশ কথা; তবে রামগরুড় বনলে বলতে হয়, আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় না আছে মূল্যবোধ না আছে সারবত্তা। রাজধর্মের নীতি, রাজ্যপাটের হাল সেখানে অবান্তর। এ প্রসঙ্গে উঠে আসে হান্না আরেন্ট বিবৃত অন্য লক্ষণটা। তাঁর বর্ণিত সমাজে অন্যায়-অনাচার, হিংসা-বিদ্বেষ স্বাভাবিক ও অভ্যস্ত, হয়তো এত স্বাভাবিক যে ভ্রুক্ষেপেই পড়ে না। নিজেদের দিকে তাকাই। দোরগোড়ায় বোমাবাজি-তোলাবাজি-নারীলাঞ্ছনা আমাদের দৈনন্দিন ছন্দে বাঁধা। জেলায় জেলায় অভ্যস্ত অশান্তি থেকে থেকে দাঙ্গায় ফেটে পড়ে ইনফোটেনমেন্টের উপজীব্য হয়ে। অতএব আরও দূরের বিপর্যয় নিয়ে হেলদোলের প্রশ্নই ওঠে না। কাশ্মীরে সেনা দেশের সেবায় নিহত হলে টনক নড়ে, নেহাত কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠী উচ্চগ্রামে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বলে। আবার সেই সেনার ছররা বন্দুকে কোনও শিশু অন্ধ হলে খবরটা কাগজের ভিতরের পাতা থেকে মনের ভিতরে প্রবেশ করে না। উত্তর-পূর্ব ভারতে কয়েক লক্ষ মানুষকে বন্দি বা বিতাড়িত করার তোড়জোড় চলছে, তার যাথার্থ্য সম্বন্ধে কৌতূহল বোধ করি না। ভ্রষ্টাচার, অশালীনতা প্রভৃতি অহিংস অপরাধ ধর্তব্যেই আসে না। যে নির্বাচন নিয়ে আমরা মাতোয়ারা, উত্তেজিত হই না নিরন্তর তার আপাত বিধিলঙ্ঘন নিয়ে, জানতে চাই না কর্তৃপক্ষ কেন তা নির্দোষ মনে করছে।

সত্তর-আশি বছর আগে জার্মানির নাগরিকরা নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন, ভিন্নধর্মীয় এক গোষ্ঠী প্রথমে উৎপীড়িত, তার পর স্রেফ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এত বিদ্বান দার্শনিক জাতি নিশ্চয় সন্দিগ্ধ হয়েছিল নেতৃকুলের বাগাড়ম্বরে, যার প্রধান প্রচারকের মন্ত্র ছিল কথার ভারে চৌকো জিনিসকে গোল বানিয়ে দেওয়া। কিছু লোক অবশ্যই সরাসরি যুক্ত ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের পাশবিক ক্রিয়াকর্মে। আরও বহুগুণ মানুষ যাঁরা ছিলেন না, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে সমাজে স্বগৃহে সজ্জনের মতো নিরীহ জীবন যাপন করেছেন, তাঁরাও নিশ্চয় ব্যাপারটা আঁচ করেছিলেন বা করতে পারতেন। হয়তো চাননি বলেই করেননি, ভেবেছিলেন তাঁরা এমন অবস্থায় দিব্যি আছেন, তাঁদের পবিত্র পিতৃভূমি দাপটে-সম্মানে দুনিয়ার নজর কাড়ছে, তার নাগরিক হিসাবে না-হয় কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হল, প্রাণ দিতে হল পর্যন্ত। ভুল ভাঙল যখন, বৃহত্তর মানবিক প্রতিরোধে সেই কল্পসৌধ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।

এমন দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি আজও বিশ্বের কিছু দেশে ঘটে চলেছে, আশঙ্কায় দিন গুনছে আরও বহু দেশ। শত বিচ্যুতি-অনাচার সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ সেই সব দেশের নাগরিকদের ঈর্ষার স্থল। সেটা ভারতের ভাগ্যবিধাতার বর। সেই বিধাতার সেবা কিন্তু আমাদের হাতে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Violence Wrongdoing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE