Advertisement
E-Paper

নির্বাচনের প্রচারে ভরসা যাঁরা, তাঁদের শিল্পী বলতে আপত্তি কী?

সময়ের সঙ্গে বদলেছে ভোটের প্রচারের আঙ্গিক। তবু দেওয়াল লিখন গুরুত্ব হারায়নি। দেওয়ালের লিপিকারদের নিয়ে লিখছেন সোনালি ঘোষ ওঁরা দেওয়াল লিখন করেন। সোজা কথায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর হয়ে  ভোট দেওয়ার আবেদনের কথাটা দেওয়ালে লেখা। সঙ্গে আঁকেন দলীয় চিহ্নও।

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪২

এখন, নির্বাচনের মরসুমে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহরে আমরা ওঁদের হামেশাই দেখতে পাচ্ছি। লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকেই তাঁদের দেখা যায়। সকাল থেকে রাত— যে কোনও সময়ই হতে পারে ওঁদের কাজ করার সময়। সাতসকালে শহরের ঘুম যখন ভাল করে ভাঙে না, তখনও কাজ করতে আপত্তি নেই ওঁদের। কিন্তু ওঁরা কারা? কাজটাই-বা কী?

ওঁরা দেওয়াল লিখন করেন। সোজা কথায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর হয়ে ভোট দেওয়ার আবেদনের কথাটা দেওয়ালে লেখা। সঙ্গে আঁকেন দলীয় চিহ্নও। এক কথায়, প্রার্থীর লিখিত অথচ শব্দহীন প্রচার। তবে, যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর আবেদন লিখছেন ওঁরা, তাঁদের ওই নিদিষ্ট দলের ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ, এটা ওঁদের স্থায়ী বা অস্থায়ী জীবিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে দল ডাকে, সে দলের ডাকেই সাড়া দিয়ে কাজে নেমে পড়েন ওঁরা। ছবিটা চেনা। একজন লেখেন। আর একজন রঙের কৌটো ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকেন। কখনও আবার এক সঙ্গে দু’তিনজনকেও দেখা যায়।

আঁকার ক্যানভাস বলতে পাড়ার কোনও বাড়ির দেওয়াল। সেই দেওয়াল হতে পারে যে কোনও রঙের। তাতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই। লেখার আগে বা দলীয় চিহ্ন আঁকার আগে অনেকটা জায়গা সাদা রং করে নেন ওঁরা। তারপর সেই কাঁচা রং শুকোনোর পর্ব। এটাই ওঁদের ক্যানভাস। তার উপর নিখুঁত তুলির টানে ওঁরা লেখেন। সেই লেখাগুলোর অক্ষর কী নিখুঁত! তার সঙ্গে কত নিখুঁত ভাবে দলীয় চিহ্ন এঁকে যান ওঁরা! কিন্তু এই মানুষগুলো কারা? ভোট তো পাঁচ বছরে একবার। বাকি দিনগুলো কী করেন তারা বেঁচে থাকার জন্য?

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এমনই এক দেওয়ালের লিপিকারের কথায়, ‘‘একটা সাইনবোর্ড আঁকার দোকানে কাজ করি। ভোটের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে দোকানের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মালিকের নির্দেশমতো শহরের কোনও পাড়ার কোনও কোনও বাড়ির দেওয়ালে নির্দেশমতো লিখি বা রাজনৈতিক দলের প্রতীক চিহ্ন আঁকি।’’

সবাই যে আবার দোকানে কাজ করেন, তা নয়। এঁদের অনেকেরই আবার স্থায়ী কোনও পেশাই নেই। তাঁরা নিজে থেকে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে হয়তো-বা দেওয়াল লিখনের কাজ মেলে। হয়তো-বা মেলেও না। মিললে পাওয়া যায় কিছু পারিশ্রমিক।

এক প্রবীণ দেওয়াল লিখন শিল্পীর কথায়, ‘‘অনেক দিন আগে দলীয় চিহ্ন বা ‘এই চিহ্নে ভোট দিন’ এসব তো লিখতামই। তখন ভোটকে কেন্দ্র করে মজার মজার সব ছড়াও লেখা হত। সেই ছড়াগুলো কারা লিখতেন, তা জানি না। তবে, দেওয়ালে লেখার জন্যে আমাদের কাগজে লেখা ছড়া দেওয়া হত।’’

কিন্তু এখন ভোটের সেই সব ছড়া প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে প্রচার করার রীতিও। সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে কমে এসেছে দেওয়াল লিখনের সংখ্যাও। প্রচারের একটা বড় অংশ দখল করে নিয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা নিছকই সাদামাটা মেসেজ। ভোটের আগে দেওয়াল লিখন তো অস্থায়ীভাবে রোজগার করা। এর সঙ্গে স্থায়ী আরও অনেক কিছু মিলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে এঁদের অনেকেরই।

একদিন সাইনবোর্ড লিখে বা বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন লিখে রোজগারের উপর ওঁদের অনেকেরই ভরসা ছিল। কিন্তু গ্লোসাইন বোর্ড আর কম্পিউটার টাইপিং হাত বাড়িয়েছে সেখানে। তার সঙ্গে বহুজাতিক সংস্থার চোখ ধাঁধানো সাইনবোর্ড তো আছেই।

আধুনিকতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়েছে সাবেকিয়ানা। এখনও সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যাবসা করতে নামা কোনও দোকান থেকে হয়ত সাইনবোর্ড লেখার বরাত মেলে। কখনও-বা ফেস্টুন লেখার। কিন্তু ভবিষ্যতে সেটুকুও মিলবে তো? প্রশ্নটা পিছু ছাড়ে না ওঁদের। স্বাভাবিক ভাবেই দেওয়াল লেখার কাজের লোকজন এখন হাতে গোনা যায় ।

অনিশ্চয়তার জন্যে নতুন কেউ এখন আর এ কাজে খুব উৎসাহ বোধ করে না। হয়তো একদিন আধুনিক প্রযুক্তি গ্রাস করে নেবে দেওয়াল লিখন। হাতে আঁকা অক্ষর গল্পগাথায় পরিণত হবে। ভোটের সময় দেওয়ালে লিখে বা দলীয় চিহ্ন এঁকে যে রোজগারটুকু হয়, সেটা কারও কাছে বাড়তি রোজগার। কারও কাছে বা হঠাৎ ক’দিনের জন্যে রোজগার করার স্বাদ নেওয়া। পরিমাণ যাই হোক না কেন, ওঁদের কাছে সেটাই অনেক।

ভোটের কিছুদিন পর, ওঁরা আবার ফিরে আসেন সেই দেওয়ালগুলোর কাছে। আবারও সাদা রং করা। তবে, এবার আর লেখা বা ছবি আঁকার জন্য নয়। যা এতদিন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গুরুত্বও হারিয়ে গিয়েছে। তাই নিয়মমতো িনজের হাতে এবার মুছে দিতে হবে নিজেরই হাতে লেখা শব্দ আর ছবিগুলো।

ওঁদের কী কষ্ট হয়? একবারও কি মনে হয় না যে, কত নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের ফসল মুছে যাচ্ছে একটু একটু করে?

প্রথাগত শিক্ষা হয়তো তেমন কিছু নয়। ছবি আঁকার কোন পাঠও হয়ত নেননি অনেকে। কিন্তু এঁরাও কি শিল্পী নন? প্রতীক চিহ্ন যিনি এমন নিখুঁত ভাবে আঁকতে পারেন, এত সুন্দর যাঁর হাতের লেখা— তাঁকে একজন শিল্পী ভাবতে ক্ষতি কী? দেওয়াল লিখনের এই মানুষগুলোর মধ্যেও তো শিল্পীসত্ত্বা লুকিয়ে থাকে। হয়তো তাঁরা কোনও দেওয়ালে কোনও মনীষীর ছবি আঁকেন নিঁখুত তুলির টানে। কিছুদিন পর বৃষ্টি অথবা শ্যাওলা মুছে দেয় তাঁদের শিল্পীমনের সামান্য চিহ্নটুকুও।

এ সব নিয়ে চিন্তাভাবনার তেমন অবকাশও মেলে না তাঁদের অবশ্য! গিলে খাওয়া দারিদ্র্য কখনও পিছু ছাড়ে না যে!

(লেখক জলপাইগুড়ির ফুলবাড়ি হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Lok Sabha Election 2019 Wall Writers Artist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy