আমাদের গর্বের বাংলায় গণপিটুনি প্রায় রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে ও হবে। বাঙালি আবেগনির্ভর। এক একটা ঘটনা ঘটে, গণমাধ্যমগুলি আবেগনির্ভর খবরে ও লেখায় ভরে ওঠে। দিন যায়, ভুলে যাই। আবার একটা খবর, আবার লেখা ও দেখা। আবার আবেগ, আবার ভোলা।
এই ধরনের ঘটনা বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত হলেও তার কারণ অনেক গভীর। প্রথমেই বলে রাখা ভাল, এই উন্মত্ত জনবিচার (মব জাস্টিস) একটি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ও সামাজিক সমস্যা। যখন গুটিকয়েক লোক বা বিশাল জনতা উন্মত্ত ভাবে নিজেদের হাতে বিচার তুলে নেয় এবং এক বা একাধিক মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তাদের গণধোলাই দেয়, সে ক্ষেত্রে উন্মত্ত জনতা নিজেরাই অভিযোগকারী, নিজেরাই বিচারক, নিজেরাই আইনজীবী এবং নিজেরাই হাতেনাতে দণ্ডদাতা। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটাই খুব অল্প সময়ে ঘটে যেখানে সেই দুর্ভাগা অভিযুক্তের কিছু বলার বা করার কোনও সুযোগই থাকে না। এদের নিয়তি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় চরম শারীরিক বা মানসিক আঘাত, নয় মৃত্যু। এই উন্মত্ত জনবিচারের পরিসরটি এক মুহূর্তের জন-মানসিকতা তৈরি করে যেখানে ব্যক্তিগত চরিত্র, জীবন, পেশা, বুদ্ধি ও বিচারের মন কাজ করে না। এই জনমন ব্যক্তিকে তার মতামত, ধারণা এবং কাজ থেকে পৃথক করে এক ধরনের যৌথমন তৈরি করে যেখানে ব্যক্তি তার অনুভব, তার চিন্তা এবং তার কাজ করার ক্ষমতা থেকে বিরত থেকে এক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বিরাজ করে। গুটিকয়েক মানুষ এই অত্যাচার শুরু করে, পরে সংক্রামিত হয়ে উন্মত্ত জনতাই সেই বিচার মেনে নিয়ে আরও বেশি করে অত্যাচার করে।
যে সমাজে অজ্ঞানতা, অরাজকতা সর্বব্যাপী, ন্যায়বিচার বিলম্বিত, আইনব্যবস্থায় অনাস্থা প্রবল, সেখানে উন্মত্ত জনবিচার এক বড় সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে তাই উন্মত্ত জনবিচার প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দেখা দিচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলিতে এটা দৈনন্দিন ঘটনা। এশিয়ায়, এবং ভারতে, এই ব্যাধি ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়ছে।
জনাচরণ কয়েকটি তত্ত্বের সাহায্য ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। জনতা তাদের সদস্যদের উপর একটি সম্মিলিত সম্মোহক প্রভাব প্রয়োগ করে, যা অযৌক্তিক কিন্তু একই মানসিকতার আচরণ তৈরি করে, যেখান থেকে উন্মত্ত জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। এটিকে সাধারণত উন্মত্ত জনতার সংক্রমণ তত্ত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। আর একটি তত্ত্ব হল কেন্দ্রাভিমুখিতার। উন্মত্ত জনাচরণ এক দল লোকের উন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এক দল সম-মানসিকতার মানুষের একজোট হওয়া। এই জনতা নিজেদের হিংসায় উৎসাহ দেয় বলে তারা উন্মত্ত হয় না। বরং এক দল লোক যারা হিংসাত্মক হতে চায় তারা একসঙ্গে হয়ে এই উন্মত্ত জনতা সৃষ্টি করে। উপরের দুই তত্ত্বকে এক করে আমরা এই ধারণা পাই যে, এক দল সম-মানসিকতার মানুষ, যারা সংসারে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত বা বঞ্চিত— কাজের কাছে, কাজের উপরওয়ালার কাছে, দোকানের কাছে, বাজারের কাছে, বাসের কাছে, ট্রেনের কাছে, পাড়ার কাছে, স্ত্রীর কাছে, ছেলেমেয়ের কাছে, প্রেমের কাছে, একটুকরো ভালবাসার কাছে, এমনকি একটু ভাল ব্যবহারের কাছে, তারা এক হয়ে কয়েক মুহূর্তে সৃষ্টি করেছে জনমন, যে জনমন তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিসত্তা থেকে আলাদা, যে জনমন ব্যক্তিমনকে ছদ্মবেশ দেয়, ভাবতে দেয়— আমাকে কেউ চিনতে পারবে না, এই সুযোগ। সেই ছদ্মবেশী, সুযোগসন্ধানী, নির্যাতিত, বঞ্চিত, অবহেলিত ও অবদমিত, প্রেমহীন, উচ্ছৃঙ্খল জনমন করে উন্মত্ত জনবিচার। যেখানে যৌবনে জড়ানো এক যুগল না পায় ভাষা, না পায় ন্যায়বিচার, শুধু পায় উন্মত্ত জনবিচারের অশ্রাব্য ভাষা আর মার। যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক চিকিৎসকরা সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও এক দুরারোগ্য রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে উন্মত্ততার শিকার হয়। যেখানে শুধু স্থান, কাল, পাত্র ভেদে শিকার ও শিকারির পরিবর্তন হয়, কিন্তু ঘটনা ঘটতেই থাকে, অন্তহীন ঢেউয়ের মতো। সে সমাজ আমার, সে সমাজ আপনার।
যে কোনও সমাজেই মানুষ সুস্থ ভাবে শান্তিতে জীবনযাপন করতে চায়। তার জন্য তারা কিছু সামাজিক রীতিনীতি ও আচরণবিধি পালন করে। যদিও প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়, তবুও বলা যায় যে বেশির ভাগ লোকই এই বিধি ও নীতিমালা মেনে চলে। কিন্তু কিছু লোক এগুলি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। তারা শুধু বর্তমানটাই দেখে, ভবিষ্যৎ তাদের কাছে মূল্যহীন। উন্মত্ত জনবিচারকরা এই দ্বিতীয় দলের। যে বা যারা গণপিটুনিতে চিহ্নিত হয়েছে তারা এখন কী ভাবে তাদের পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজে মুখ দেখাচ্ছে সেটা ভাবার, সেটা দেখার। সমাজ বা পরিবার তাদের প্রতি কী আচরণ করে সেটাও দেখার। এটা দেখার যে, পিটুনিবাজরা মুখ লুকিয়ে আছে না সমাজের কাছে কৃতিত্ব দাবি করছে।
প্রায় দুই দশক আগের কথা। সকালবেলা বাজার যাওয়ার সময় দেখলাম একটা রুগ্ণ শীর্ণ ছেলেকে বাজারপাড়ার কয়েক জন লাইটপোস্টে বেঁধে রেখেছে আর গালাগালি করছে। মাঝে মাঝে ফ্রি চড়চাপড়। কিছু ক্ষণ পরে ফেরার সময় দেখি কয়েক জন কমে দু’তিন জন হয়েছে। কিন্তু লাইটপোস্টের পাশে বেশ বড়সড় চলমান ভিড়। বাজার-ফেরতা এক এক জন পুরুষ বাজারের থলিটা রাস্তায় বা পাশের বন্ধ দোকানের সামনে রাখছে আর কিছু না শুনে, না বুঝে দু’চারটে বাছা বাছা গালাগালি দিতে দিতে ছেলেটিকে কয়েকটা চড়থাপ্পড় দিয়ে ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে বাজারের থলিটা নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিচ্ছে। পরে এক দল এসে প্রবল প্রতিবাদ করতে লাইটপোস্টের ছেলেটি মুক্তি পায়, হয়তো মানসিক বা শারীরিক মৃত্যু থেকে, বা দুটোর থেকেই। আমরা অনেকেই এ ধরনের ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী।
বেশির ভাগ হিংসাত্মক ঘটনার মতো, উন্মত্ত জনবিচারেরও তিনটি প্রধান স্তম্ভ: হিংসাকারী, হিংসার শিকার আর মজা লোটা দর্শক। এই দর্শকরা প্রায়শই দ্রুত হিংসাকারীতে পরিবর্তিত হয়, তাদের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে হিংসাভোগীর মানসিক ও শারীরিক আঘাতের মাত্রাও বাড়তে থাকে, যা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়। কয়েক বছর আগেও আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতি ও শৃঙ্খলার সংহতি বেশি ছিল, তাই এ ধরনের যূথবদ্ধ অন্যায়ের প্রতিবাদ তুলনায় কার্যকর হত। দর্শকদের থেকেই প্রতিবাদ আসত, ফলে হিংসাকারীর সংখ্যা বাড়ত না। এখন অনেক সময়েই ঘটে ঠিক উল্টো।
প্রতিবাদ এখনও হয়। হচ্ছেও। কিন্তু সেটা দূরের, পরের, আবেগের বা ক্ষোভের প্রকাশ। সেটা ভাল, কিন্তু তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। প্রতিবাদ আসা উচিত ওই সামাজিক অপরাধীদের পরিবার থেকে, তাদের প্রতিবেশীদের থেকেও। মনে রাখা উচিত, ব্যক্তি থেকে পরিবার থেকে প্রতিবেশী থেকে সমাজ। তাই যে সমাজ আমরা দেখতে চাই, পরিবার ও প্রতিবেশীকে সেই রকম ব্যক্তির দল তৈরি করতে হবে। দোষ দেওয়া সহজ। কারণ খোঁজা কঠিন। আসুন, দোষ না দিয়ে কারণ খুঁজি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy