Advertisement
E-Paper

অন্ধকার ঘুচল কোথায়?

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী কিছুই বলবেন না। একটি শব্দও না। সঙ্গী নির্মল বসুকে বললেন, ‘‘আই মাস্ট নট ইলড টু দ্য টেম্পটেশন।’’ বললেন, ওরা ভুলে যাক যে আমি ইংরেজি জানি।

হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০

স্বাধীনতার ব্রাহ্মমুহূর্ত এসে পড়েছে প্রায়। আর মোটে চার দিন বাকি। আটাত্তর বছরের বিধ্বস্ত, ক্লান্ত বৃদ্ধ কলকাতায়। বেলেঘাটার বাড়ি তাঁর আস্তানা। বিবিসি তাঁর কাছ থেকে বার্তা চাইল। শুধু ইংরেজি নয়, তাঁর সেই বার্তা সম্প্রচারিত হবে বিশ্ব জুড়ে বেশ কয়েকটি ভাষায়।

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী কিছুই বলবেন না। একটি শব্দও না। সঙ্গী নির্মল বসুকে বললেন, ‘‘আই মাস্ট নট ইলড টু দ্য টেম্পটেশন।’’ বললেন, ওরা ভুলে যাক যে আমি ইংরেজি জানি। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োকে বলেছিলেন, ‘‘আই হ্যাভ রান ড্রাই।’’

তিনি নীরব থাকতে চেয়েছিলেন, কারণ এই স্বাধীনতা তিনি চাননি। তাঁর মনে হয়েছিল, সত্যিই তাঁর কিছু বলার নেই। চার দিকে এত রক্তারক্তি, হানাহানি, অবিশ্বাস, ঘৃণার বাতাবরণ! মাস কয়েক আগেই তো ঘুরে এসেছেন নোয়াখালিতে। অমৃতবাজার পত্রিকা লিখল, ‘‘গাঁধীজি’স এপিক ট্যুর বিগিনস।’’ সাতান্ন দিনে সাতচল্লিশটা গ্রাম খালি পায়ে ঘুরলেন মানুষের বিবেক আর চৈতন্য ফেরাতে। এবং হাতে বাঁশের লম্বা লাঠি, অন্য হাত মনুর (গাঁধী) কাঁধে। সফরসঙ্গীদের হিসেব বলে, ১১৬ মাইল সব মিলিয়ে। মোহনদাসের নিজের কথায়, এটা তাঁর তীর্থযাত্রা।

এই তীর্থযাত্রায় তাঁকে কী করা হল? হ্যান্ডবিল ছড়িয়ে হুমকি দেওয়া হল, ‘‘আমরা তোমাকে অনেক সাবধান করেছি, ফিরে যাও, না হলে কপালে দুঃখ আছে।’’ তাঁর যাত্রাপথে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দেওয়া হল। বার বার অপমানিত হলেন পথে ঘাটে। কিন্তু তিনি দমেননি। মনে গভীর দুঃখ নিয়েও দমেননি।

সেই বিষাদ তিনি ব্যক্ত করেছিলেন ১৫ অগস্ট ১৯৪৭-এ, বাংলার রাজ্যপাল রাজাগোপালাচারির কাছে। মোহনদাস উঠে পড়েছিলেন রাত দু’টোয়। প্রার্থনা সেরে চরকা কেটেছিলেন নিয়মমাফিক। সারা দিন শুধু ফলের রস খেয়ে ছিলেন। বেলেঘাটার বাড়ির বাইরে সকাল থেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। যাঁরা কিছু দিন আগেই এই শহরে পরস্পরের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন শানিত অস্ত্র নিয়ে। রাজাগোপালাচারি এলেন এই ‘চমৎকারের কারিগর’ বৃদ্ধকে অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু গাঁধীর মনে শান্তি কোথায়? এত উল্লাস উন্মাদনা, আলোর রোশনাইয়ের মধ্যেও গাঁধীজির শান্তি কোথায়? তিনি বললেন, ‘মানুষের হৃদয় পরিবর্তন না হলে কী অর্থ এই স্বাধীনতার? উৎসবের আবহ কয়েক দিনের মধ্যেই শান্ত হবে। ভেতরের পরিবর্তন না হলে অন্ধকার ঘুচবে কি, আতসবাজির উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও?’

একাকী, ব্যথিত বৃদ্ধ তাঁর যাবতীয় সংশয়কে সত্য প্রমাণিত করে বুকে বুলেট নিলেন ঠিক সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায়। কিন্তু তাঁর শাস্তির আরও বাকি ছিল। সত্তর বছর পরে পোরবন্দরের এই গুজরাতি বানিয়ার ‘চাতুর্য’ আবিষ্কার করেন তাঁরই এক দেশোয়ালি উত্তরপুরুষ। দেশ জুড়ে উন্নয়নের স্বপ্নকে গাজর হিসেবে ঝুলিয়ে দিল্লি দখল করে যিনি ও তাঁর অগ্রজ ভ্রাতৃপ্রতিম, শিশুর সারল্য নিয়ে একের পর এক এমন কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাসকে, ভরসাকে, আস্থাকে এমন ভাবে ভেঙেচুরে দিচ্ছেন নানা কায়দায়, যা আন্দাজ করার দূরদৃষ্টি, চাতুর্য সত্যিই ছিল মোহনদাসের।

মুদ্রার এক পিঠে যদি এই চিত্র হয়, অন্য দিকে কে বা কারা? নোয়াখালিতে গাঁধীকে মুখের উপর বলা হয়েছিল, ‘ভন্ডামি ছাড়ুন, পাকিস্তানকে মেনে নিন ভালয় ভালয়।’ অবিভক্ত ভারতবর্ষ, অবিভক্ত মানবসমাজ তাঁরা সে দিন চাননি। সেই ভাবনার অনুসারীরা সংহতিকে টুকরো টুকরো করার জন্য আজও দ্বিধা করেন না রক্তপাতে।

সারা জীবন নিজেকে নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো বৃদ্ধটি বলতেই পারেন— পরীক্ষায় ডাহা ফেল করলাম নাকি? অন্ধকার ঘুচল কোথায়?

ঋণ: হোয়াই গাঁধী স্টিল ম্যাটারস, রাজমোহন গাঁধী; মাই ডেজ উইথ গাঁধী, নির্মল কুমার বসু; গ্রেট সোল: মহাত্মা গাঁধী অ্যান্ড হিজ স্ট্রাগল উইথ ইন্ডিয়া, জোসেফ লেলিভেল্ড

Mahatma Gandhi freedom Independence India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy