ছবি: রয়টার্স।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখার সহিত পরিচয় থাকিলে নরেন্দ্র মোদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি ফোন করিয়া— অবশ্য তিনি সেই ফোন ধরিলে— বলিতে পারিতেন, ‘দিদি, আমি অধম, তাই বলিয়া আপনি উত্তম হইবেন না কেন?’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারিতেন না, কারণ তাঁহার নিকট ইহার কোনও সদুত্তর নাই। নূতন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ না-দিবার সিদ্ধান্তটি উত্তম তো নহেই, তাহাকে মধ্যম বলাও কঠিন, কারণ এই সিদ্ধান্ত কেবল স্বাভাবিক সৌজন্যের পরিপন্থী নহে, মুখ্যমন্ত্রীর দল ছাড়িয়া সদ্য প্রধানমন্ত্রীর দলে পরিযায়ী বিধায়ক মনিরুল ইসলামের ভাষায় বলিলে, এই ‘বয়কট’ যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের নৈতিক আচরণের শর্তকেও পায়ের তলে দলিয়া মারিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিকতার মর্যাদা ব্যক্তিগত বা দলগত রেষারেষির বহু উপরে। রাজনীতিকদের শপথের বিশ্বাসযোগ্যতা যে অতলেই নামুক, সংবিধানের নামে শপথবাক্য পাঠ করিয়া রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অনুষ্ঠান গণতন্ত্রের মূল্যবান প্রতীক। সেই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানে গণতন্ত্রের যে অসম্মান, কোনও যুক্তিতেই তাহা একটি রাজ্যের নির্বাচিত প্রশাসনিক প্রধানকে মানায় না।
লক্ষণীয়, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হইয়াও অনুপস্থিত থাকিবার সিদ্ধান্তটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একার নহে। যেমন, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক সঙ্গত কারণেই দিল্লি যাইতে পারেন নাই, সে কথা যথাবিহিত জানাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে যাইবেন বলিয়া স্থির করিলেও সহসা মত বদলাইয়াছেন এবং সেই মত বদলের কথা জানাইয়াছেন যুদ্ধঘোষণার স্বভাবসিদ্ধ শৈলীতে। তাঁহার অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীরা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে তৎপর, তাহার প্রতিবাদেই এই বয়কটের সিদ্ধান্ত। অভিযোগটি অসঙ্গত নহে। বিজেপির দাবি, পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক মাসে তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণে তাঁহাদের অনেক সদস্য নিহত হইয়াছেন। তাঁহাদের আত্মীয়স্বজনদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এই আমন্ত্রণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ভোটের ফল প্রকাশের কার্যত পরমুহূর্ত হইতে মোদী-শাহের অনুগামীরা যে উৎকট ব্যগ্রতায় পশ্চিমবঙ্গ বিজয়ের দলীয় অভিযান চালাইতেছেন, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকেও সেই ধারায় শামিল করিয়া শাসক দল অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং আপত্তিকর রাজনীতি করিতেছে, গণতন্ত্রের মর্যাদাহানি ঘটাইতেছে। প্রতিবাদ করিয়া মুখ্যমন্ত্রী কোনও ভুল করেন নাই। কিন্তু প্রতিবাদের অনেক উপায় আছে, বয়কট সদুপায় নহে। তুমি অধম হইলেও আমি উত্তম হইব না কেন?
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরা এই অ-গণতান্ত্রিক বয়কটের পথই অনুসরণ করিয়া আসিতেছেন। কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ থাকিতেই পারে। কোনও কোনও জমানায়, দিল্লীশ্বররা ক্ষমতার অতিব্যবহার করিয়া রাজ্যের আনুগত্য আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন, অবাধ্য রাজ্যকে বঞ্চনা করেন। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজ্যের প্রতিবাদ নিশ্চয়ই সঙ্গত, আবশ্যকও। কিন্তু প্রতিবাদ বা দর কষাকষির জন্য বরং কেন্দ্রের সহিত আলোচনা দরকার, আদানপ্রদান দরকার। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমাগত ‘খেলিব না, আড়ি’ নীতি অনুসরণ করিয়াছেন। কেন্দ্রের সহিত যৌথ কর্মসূচি হইতে রাজ্য সরিয়া দাঁড়াইয়াছে, কেন্দ্রের আয়োজিত বিভিন্ন সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী যান নাই বা প্রতিনিধি পাঠান নাই, কেন্দ্রীয় প্রশাসনে রাজ্যের আধিকারিকদের রীতিসম্মত ভূমিকা পালনে বাধা সৃষ্টি করিয়াছেন। প্রশাসন এবং দলের মধ্যে ন্যূনতম পার্থক্য না করিবার এই প্রবণতা রাজ্যের বড় ক্ষতি করিয়াছে, আরও বড় ক্ষতি করিয়াছে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য। দুর্ভাগ্য তাহার মুখ্যমন্ত্রীরও। নূতন পরিস্থিতিতে আত্মসংশোধনের সুযোগ তিনি পায়ে ঠেলিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy