Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
তাঁর মৃত্যুতে বড় ক্ষতি হল

সামির আমিন অনুন্নয়নকে দেখেছিলেন আগ্রাসী পুঁজির বিপ্রতীপে

পিএইচ ডি গবেষণা করতে করতেই ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। অন্য দিকে তাঁর নিজের দেশ মিশর তথা তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে নিরন্তর মনপোড়ানি। মিশরে তখন রাজ পরিবারকে সরিয়ে নাসেরের আমল। সামির যুক্ত হলেন কায়রোর ইনস্টিটিউট ফর ইকনমিক ম্যানেজমেন্ট-এ।

অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল আর মাস কয়েকের মধ্যেই। দেখে যেতে পারলেন না। সাতাশি বছর বয়সে চলে গেলেন এ কালের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী পণ্ডিত সামির আমিন )ছবিতে)মার্ক্সবাদী তত্ত্বের পরিসরে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নয়নের তত্ত্বায়নে যাঁদের অবদানের কথা বলতেই হয়, সামির আমিন তাঁদের অন্যতম।

জন্ম মিশরের কায়রোতে, ১৯৩১ সালে। উত্তর আফ্রিকার এলিট পরিবারগুলির পরম্পরা অনুসারে উৎকৃষ্ট ফরাসি শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন, যে শিক্ষা সে সময়ে সাধারণত শেষ হত প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়ে। সামিরের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছিল। ১৯৫৭-তে প্যারিসে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে গবেষণা শেষে পিএইচ ডি। অতঃপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তক রচনা ও অধ্যাপনা ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে যে নিশ্চিন্ত জীবন, তা নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করে যেতে পারতেন। কিন্তু সে কালটাই ছিল যে অন্য রকম। পিএইচ ডি গবেষণা করতে করতেই ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। অন্য দিকে তাঁর নিজের দেশ মিশর তথা তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে নিরন্তর মনপোড়ানি। মিশরে তখন রাজ পরিবারকে সরিয়ে নাসেরের আমল। সামির যুক্ত হলেন কায়রোর ইনস্টিটিউট ফর ইকনমিক ম্যানেজমেন্ট-এ। আশা, দেশের অর্থনীতির জন্যে করবেন কিছু। তিন বছর কাজও করলেন। কিন্তু কমিউনিস্টদের ওপর নাসেরের অত্যাচার যখন বাড়তে থাকল, চলে গেলেন সদ্য স্বাধীন দেশ মালির বোমাকোয়। পরের তিন বছর কাজ করলেন মালি সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রকের উপদেষ্টা হিসেবে।

এই কবছরের অভিজ্ঞতায় তাঁর যে গভীর উপলব্ধি হল, তা-ই তাঁর তাত্ত্বিক অবদানের ভিত তৈরি করে দিল। বুঝলেন, মিশর বা মালির মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নীতি তৈরির স্বাধীনতা কতটা সীমিত। আর তার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন একচেটিয়া পুঁজির আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রসারকে। বহুজাতিক পুঁজির পুঞ্জিভবন প্রক্রিয়ারই উল্টো পিঠ হল তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকের সুপার-এক্সপ্লয়টেশন বা মহা-শোষণ, যে হেতু এখানে শ্রমশক্তির মূল্য প্রথম বিশ্বের থেকে অনেকটাই কম। অর্থাৎ, সামিরের মতে, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নয়ন আর একচেটিয়া পুঁজির বিস্তার একই প্রক্রিয়ার অঙ্গীভূত।

ষাট বছরে তিনি লিখেছেন অনেক। কিন্তু কখনও এই মূল অবস্থান থেকে বিশেষ সরে আসেননি। যে মূল ধারণাগুলো তাঁর রচনায় ঘুরেফিরে আসে, তা হল একচেটিয়া ফিনান্স পুঁজি, মার্ক্সের মূল্যতত্ত্ব এবং আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ। বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী ফিনান্স পুঁজি যে ভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এক রকম অধীনতায় বেঁধে ফেলছে, তা নিয়েই বার বার লিখেছেন, কিন্তু প্রতি বারই তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির সমকালীন ঘটনাবলিকে। আর এখানেই সামিরের বিশেষত্ব। তত্ত্ব ভাবতে বসে এক বারের জন্যেও রাজনীতি থেকে চোখ সরাতে হয়নি। যাকে তিনি বলছেন আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ, তার বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বে কী ভাবে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে ভেবেছেন সদাই। লড়াই-খ্যাপা? না, রাজনীতির বাস্তবের মাটিতে পা রেখে চলেছেন বরাবর।

পুঁজিবাদের বর্তমান পর্যায়ে, বিশেষত বিগত আড়াই-তিন দশকে বিশ্বমঞ্চে চিনের উত্থানের সঙ্গে সাধারণ ভাবে সাম্রাজ্যবাদের ধারণাটি কতটা প্রাসঙ্গিক, এ নিয়ে মার্ক্সবাদীদের মধ্যেই বিতর্ক আছে প্রচুর। সামিরের তত্ত্বও কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে, কিন্তু তাঁকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। তিনিও যুক্তি শানিয়ে গিয়েছেন একের পর এক রচনায়, ধারাবাহিক ভাবে নতুন মাত্রা এনেছেন তাঁর তত্ত্বে। মার্ক্সবাদ তাঁর কাছে একটি সৃষ্টিশীল বিষয়। আর তাঁর মতে, এই সৃষ্টিশীলতাকে ব্যবহার করে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমাজ এবং তার সঙ্গে সতত পরিবর্তনশীল বিশ্বপুঁজিবাদের সম্পর্ক কী, তা যদি বুঝতেই না পারা গেল, তা হলে আর মার্ক্স চর্চার প্রয়োজন কী? এই তাগিদ থেকেই তাঁর তত্ত্বায়ন।

শুধু তত্ত্ব আর বৌদ্ধিক চর্চাতেই সামির নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। আর সেখানেই সামির অন্য রকম।আরব বসন্তথেকে আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকায় যে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল বছর কয়েক আগে, তার সঙ্গে তিনি শামিল হয়েছেন তাঁর গভীর চিন্তাভাবনা দিয়ে।

তিনি মনে করতেন, আমাদের সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ যথাযথ বুঝতে মার্ক্সবাদের বিকল্প নেই। এর মধ্যে হয়তো অনেকে ধর্মান্ধতার গন্ধ পাবেন— ‘ব্যাদের মতোই, সবই যেন মার্ক্সে আছে। কিন্তু তাঁর লেখাপত্রের সঙ্গে পরিচিত হলে সেই ধারণা ভাঙবে। বিশুদ্ধবাদীদের মতো মার্ক্সের কোন রচনার কত পৃষ্ঠায় কোন উদ্ধৃতি রয়েছে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে কালাতিপাত করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ।

তাঁর রচনার তাগিদটা যে হেতু আসত সাম্রাজ্যবাদ ও একচেটিয়া ফিনান্স পুঁজির বিরুদ্ধে ঘটমান বা ঘটিতব্য নানান আন্দোলন থেকে, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, তাঁর তাত্ত্বিক রচনা আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও মতবিনিময় একই অনুশীলনের অংশ বলে সামির মনে করতেন। জীবনের প্রায় পুরোটাই তিনি কাটিয়েছেন আফ্রিকার কোনও দেশে। শেষ চল্লিশ বছর ছিলেন সেনেগালের ডাকার-এ। সেখান থেকেই সারা বিশ্বের মার্ক্সবাদী চিন্তক ও পার্টিগুলির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। এ দেশের অনেকের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল। কলকাতায়ও এসেছেন বক্তৃতা দিতে।

দশ বছর আগেপলিটিকাল ইসলাম ইন দ্য সার্ভিস অব ইম্পিরিয়ালিজ়মশিরোনামে একটি চিন্তাঋদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ লেখেন সামির। পলিটিকাল ইসলাম বলতে তিনি এখানে সেই মতাদর্শভিত্তিক অবস্থানকে বোঝাচ্ছেন, যা আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপক অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয়।মুসলিম ব্রাদারহুডকে এই শ্রেণিতে ফেলা যায়। এই সব অঞ্চলে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনকে বুঝতে গেলে পলিটিকাল ইসলাম বোঝা জরুরি। এর সমস্ত ধারাই কিন্তু পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামের সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে নিশানা করে লড়াইটা সংগঠিত করে। আর সহজেই জনপ্রিয়তাও পেয়ে যায়। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ভিন্নতাটি শুধুমাত্র ধর্মেই প্রোথিত বলে ধরে নেয় তারা। সামিরের মতে এটাই চরম দুর্ভাগ্যজনক। সংস্কৃতির দ্বন্দ্বকে এ ভাবে পুরোপুরি ধর্মের আদরায় ঢুকিয়ে নেওয়ায় আসল দ্বন্দ্বটা চাপা পড়ে যায়। একচেটিয়া পুঁজির আগ্রাসন থেকে উৎসারিত, বিশ্বায়িত পুঁজি আর প্রান্তস্থিত বিশ্বের প্রান্তিক শ্রেণিগুলির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তা-ই তো আসল দ্বন্দ্ব। সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব দিয়ে শুরু করেও জনচেতনাকে ও দিকে চালিত করা হয়তো যেত। কিন্তু ধর্মীয় আধারে পুরোপুরি আটকে রাখায় সে সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়।আরব বসন্তআন্দোলনে যেমন।

এখানে লক্ষ করার মতো বিষয় হল, সামির প্রথাগত মার্ক্সবাদীদের মতো সংস্কৃতির দ্বন্দ্বকে হেলাফেলা করছেন না একেবারেই। তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে জানেন, এটা কতটা বাস্তব। কিন্তু সাংস্কৃতিক পার্থক্যের দ্বন্দ্ব সেখানেই রয়ে যায়, একচেটিয়া পুঁজির আগ্রাসনের বিরোধিতার দিকে যায় না। অথচ পলিটিকাল ইসলামঅন্তত এর উগ্রপন্থী অংশটিসব সময়েই দাবি করে আসে তারা পশ্চিমি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এর পর অবশ্য তাঁর সমালোচনার সুর আরও উঁচু পর্দায় চড়িয়ে যুক্তি দিয়ে দেখান, পলিটিকাল ইসলাম আসলে মেট্রোপলিটান পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনেরই সাহায্যে আসছে।

তাঁর বিশ্লেষণ কিন্তু সমালোচনা থেকে হতাশায় গিয়ে শেষ হয় না। এ সব অঞ্চলের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনগুলি কী ভাবে পলিটিকাল ইসলামের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে একটা প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের দিশা দিতে পারে, তা নিয়েই সুচিন্তিত এবং বাস্তবোচিত রাজনৈতিক পদক্ষেপের আলোচনা। বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন পলিটিকাল ইসলামের জনপ্রিয়তার কথা। বলছেন, একে অবজ্ঞা বা ঘৃণা দেখিয়ে প্রগতিশীল শিবিরের কোনও ফায়দা হবে না। আবার এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে এদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করেও লাভ নেই, কারণ জেতার পরে নিদারুণ অবজ্ঞা ছাড়া এদের থেকে আর কিছু জুটবে না। যুক্তিগুলি আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য রাজনীতির জন্যেও সমান প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে না?

সামির আমিনের অনেক বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হতে না পারলেও বলতে দ্বিধা নেই, আজ গোটা বিশ্বেই কি তত্ত্বে, কি রাজনৈতিক অনুশীলনে, অন্য রকম কণ্ঠস্বরের পরিসর যখন ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে, তখন তাঁর মতো মানুষের চলে যাওয়ায় এই সময়ের বড় ক্ষতি হল।

অর্থনীতিবিদ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা-র অধিকর্তা। মত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Economist Marxian Samir Amin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE