Advertisement
E-Paper

প্রাপ্তবয়স্করা শুনবেন কি

এতগুলো বন্ধুর এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা ফ্লরিডা-র মারজরি স্টোনম্যান ডগলাস হাই স্কুলের দুই পড়ুয়া অ্যাডাম বুখওয়াল্ড আর জাক হিবসম্যানকে ভাবিয়ে তোলে।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৮ ০৬:১০

বন্দুক থেকে জলের মতো বেরিয়ে এল গুলি। চোখের সামনে ছিটকে, চেঁচিয়ে, হাত-পা ছটকে, রক্ত ছড়িয়ে দুড়দাড় পড়তে লাগল ওরা। আর উঠল না। একটু আগেও হেসেখেলেনেচে বেড়াচ্ছিল, এখন ছোট-ছোট দেহগুলো পড়ে রয়েছে মাটিতে, বেঞ্চের ধারে, ডেস্কের ওপর মুখ থুবড়ে। বন্ধুরা ভয়ে, কুঁকড়ে গিয়েছে। জীবনের অনিত্যতা বুঝে ফেলেছে এক নিমেষে।

এতগুলো বন্ধুর এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা ফ্লরিডা-র মারজরি স্টোনম্যান ডগলাস হাই স্কুলের দুই পড়ুয়া অ্যাডাম বুখওয়াল্ড আর জাক হিবসম্যানকে ভাবিয়ে তোলে। তারা ভাবে, কিছু একটা না করলে বন্দুকবাজের দল একের পর এক স্কুলে এসে এ রকম ভাবেই ছাত্রছাত্রীদের মেরে শেষ করবে, যেমনটা তারা করে চলেছে বিরাট দেশটার এখানে ওখানে সেখানে। আজ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবই— এমন ভরসা ভ্যানিশ করে যাচ্ছে। কিছু একটা করতে হবে। মা-বাবার ওপর, বড়দের ওপর, রাষ্ট্রের ওপর চোখ বুজে ভরসা করে থাকলে আর চলবে না, আমাদেরই হাতে তুলে নিলাম আত্মরক্ষার দায়। এই উপলব্ধি থেকেই অ্যাডাম আর জাক তৈরি করেছে এক চুক্তিপত্র: ‘পেরেন্টস প্রমিস টু কিড্স’। সেই চুক্তি হবে ছোটদের সঙ্গে তাদের মা-বাবার। তাতে বলা থাকবে, ‘আমি (আমার সন্তানকে) প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে নেতা (যে দলেরই হোন তিনি) আমার সন্তানের নিরাপত্তাকে বন্দুকের চেয়ে বেশি মূল্য দেবেন, আমি তাঁকেই ভোট দেব।’ দু’জনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে সহপাঠীরা, উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা, সেলেব্রিটিরাও কেউ কেউ। দু’সপ্তাহের মধ্যে ১০০০ স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র খামে বন্দি হয়ে পৌঁছে গিয়েছে দুই উদ্যোক্তার কাছে।

এই চুক্তি আকস্মিক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা রাজ্যে একের পর এক বন্দুক-হানা চলছিলই। প্রতিবাদও হচ্ছিল। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারি ফ্লরিডার ওই স্কুলে সতেরোটি প্রাণ চলে যাওয়ার ঘটনাটা কমবয়েসি ছেলেমেয়েদের ভয়ানক একটা ধাক্কা দেয়। শুরু হয় তুমুল বিক্ষোভ। প্রথমে ফ্লরিডায়। সতেরো মিনিটের মিছিল, প্রত্যেক মিনিট উৎসর্গ করা হয় এক-এক জন নিহতের উদ্দেশে। দেখতে দেখতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশ জুড়ে। নিউ ইয়র্ক, বস্টন, হিউস্টন, শিকাগো... একের পর এক শহরে বিরাট সমাবেশ হয়। হয়ে চলেছে। গত শনিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভস’ নামে তিন লাখের বেশি মানুষের প্রতিবাদ মিছিল হয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে হওয়া প্রতিবাদের পর তার তুলনা কমই দেখা গিয়েছে। এই সব সমাবেশে অল্পবয়সিরা বিরাট ভূমিকা নিয়েছে। ফ্লরিডার স্কুলে গুলি চালানোর পর বেঁচে যাওয়া পড়ুয়া ডেলানি টার বলেছে, ‘‘আমার মৃত বন্ধুদের জন্য আমরা এই লড়াই চালিয়ে যাব।’’ মেরিল্যান্ডের একটি স্কুলের ছাত্রী, এগারো বছরের জো টেট বলেছে, ‘‘আমার মনে হয় বন্দুক ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ নির্বোধ।’ এবং ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘কেবল আমাদের নয়, এই ছোট ছোট ছেলেমেয়রা জাতির বিবেক জাগ্রত করেছে। মনেপ্রাণে তোমাদের সমর্থন করি।’ তিনি আরও বলেছেন যে, এই ছেলেমেয়েরাই ‘আমেরিকার ভবিষ্যতের ভরসা’।

ভরসাটা খুব দরকারি। কারণ লড়াইটা কঠিন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে বন্দুক রাখার মৌলিক ছাড়পত্র সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতেই দেওয়া আছে। আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখার অধিকার। তার সুযোগ নিয়েছে দেশের বন্দুক ব্যবসায়ীরা। রাজনীতিতে, বিশেষ করে রিপাবলিকান পার্টির উপর তাদের বিরাট প্রভাব। বারাক ওবামা চেষ্টা করেছিলেন বন্দুকের যথেচ্ছ কারবার আটকাতে, পারেননি। অনেক রাজ্যেই মুড়িমুড়কির মতো বন্দুক বিক্রি হয়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে নাগরিকরাও, বিশেষ করে আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্যবর্তী প্রদেশগুলিতে, ভাবেন তাঁদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে! অনেকেরই বাড়ি রীতিমত অস্ত্রাগার। এই তো সে-দিন ওহায়োতে ক্লিভল্যান্ডের কাছে এক শহরে একটি আট বছরের ছেলে তার চার বছরের বোনকে গুলি করেছে। তার মা জানতে পেরে অফিস থেকে এসে মেয়ের ক্ষতে ওষুধ দিয়ে, ঘরদোর, বেডকভার পরিষ্কার করে, ফের চলে গিয়েছেন কাজে। বাড়িতে নানা রকমের বন্দুক থাকে একটি লকারে। আট বছরের ছেলেটি সেই লকার খুলতে জানে!

আর ডোনাল্ড ট্রাম্প? তিনি তো পারলে প্রত্যেকের হাতে একটা বন্দুক ধরিয়ে দেন! স্কুলে হামলা আটকাতে তাঁর সহজ সমাধান— স্কুলের শিক্ষকরা বন্দুক নিয়ে স্কুলে আসুন, তা হলেই সমস্যা মিটে যাবে। বন্দুকবাজ গুলি চালালে, শিক্ষকও পালটা গুলি চালাবে। ক্লাসরুম নিমেষে যুদ্ধক্ষেত্র! এই রাষ্ট্রনায়ককেই নির্বাচন করেছেন আমেরিকার মানুষ। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।

যাঁরা ট্রাম্পকে, বা বন্দুক নিয়ন্ত্রণের বিরোধী রিপাবলিকানদের নির্বাচিত করেছেন, তাঁরা যে প্রত্যেকেই আগ্নেয়াস্ত্রের যথেচ্ছ লেনদেনের পক্ষপাতী, তা নয়। কিন্তু অনেকেই হয়তো রিপাবলিকান পার্টির বা ট্রাম্পের অন্য অনেক সিদ্ধান্তে একমত। তার ফলেই বন্দুক রাখার ব্যাপারটাকে, একমত না হয়েও, মেনে নিতে হয়েছে। এবং এইখানেই কিশোরকিশোরীদের ভাবনার বৈশিষ্ট্য। তাদের মাথাটা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার। তারা স্পষ্ট দেখছে, বন্দুক সুরক্ষা দিচ্ছে না তাদের, বরং আরও বিপন্ন করে তুলছে দিন-দিন। তাদের কাছে লক্ষ্যটা সুস্পষ্ট। বন্দুকবাজের হামলার ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে চায় না তারা। তাই তাদের সাফ কথা, ন্যাশনাল রাইফ্ল অ্যাসোসিয়েশনের কোনও টাকা যেন আমেরিকার রাজনীতিতে জড়িয়ে না যায়। তাদের দাবি, রিপাবলিকান হোক বা ডেমোক্র্যাট— বন্দুক আইনে রাশ টানার জন্য যে লড়বে, ভোট তাকেই দিতে হবে। আর পাঁচটা ব্যাপারে তর্ক থাকুক, বন্দুক রাখার প্রশ্নে একমত হতেই হবে। কারণ এটা জীবনের প্রশ্ন, বেঁচে থাকার প্রশ্ন। একাদশী জো টেট বলেছে, ‘ভাবতে আশ্চর্য লাগছে যে, এই কথাটা আমাদেরই বোঝাতে হচ্ছে বড়দের।’

প্রাপ্তবয়স্ক অভিভাবকরা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের এই সাফ কথা বুঝবেন কি? হয়তো বুঝছেন— জনমত সমীক্ষা বলছে, বন্দুক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এখন রিপাবলিকান পার্টিরও সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থকের সায় রয়েছে। তবে কি ঘরে-ঘরে বন্দুক রাখার স্বাধীনতায় এ-বার রাশ টানা হবে? ফ্লরিডার দুই কিশোরের প্রস্তাবিত চুক্তিটিই মার্কিন রাজনীতিতে একটি জোরদার নির্বাচনী অস্ত্র হয়ে দাঁড়াবে? রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলিও, বিশেষ করে রিপাবলিকান পার্টি কি ভোটের দায়ে বাধ্য হবে মত বদলাতে? ওবামা যা পারেননি, ট্রাম্পের জমানাতেই কি তবে সেটা ঘটবে? যদি হয়, তবে পৃথিবী বদলানোর কাজটাও এক পা এগোবে।

Gun control US Teenagers
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy