সত্যি বলতে কী, এই প্রথম মুনমুন সেনকে এতটা ভাল লাগল। তাঁর অভিনয় খুব একটা দেখা হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘অসহিষ্ণুতা’ বিতর্কে তাঁর মন্তব্য ব্যতিক্রমী। তিনি ধর-তক্তা ‘পার্টি লাইন’কে অতিক্রম করতে পেরেছেন। এটা ঠিকই যে, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি অনেকটা ‘খোলামেলা’ গোছের। তবু, এই দলের ক’জনের বলার সাহস আছে, ‘অসহিষ্ণুতা বরাবরই ছিল’?
অসহিষ্ণুতার প্রশ্নটিকে শুধুমাত্র ধর্মীয় চিহ্নে দাগিয়ে দিলে হবে না। ধর্মীয় বিষয়ে সমাজের বৃহৎ অংশের গোঁড়ামি ছিল, আছে, হয়তো বা থাকবে। এই সহজ সত্যটা মেনে নিলে অনেক উপকার হয়। প্রশ্ন করতে হয়ে সেই ব্যক্তিচরিত্রকে, যা ওই গোঁড়ামিগুলিকে ধারণ করে আছে। কিন্তু মানুষ তো শুধু ধর্ম নিয়ে বাঁচে না। সমাজের নানা স্তরে তার অবগাহন। আমাদের কাছে সেই সব ব্যক্তিত্বের বিরাট কদর, যাঁরা কট্টরপন্থী। ধর্মে, জিরাফে, রাজনীতিতে, সর্বত্র। ঈষৎ দ্বিধাগ্রস্ত, চিন্তাভাবনায় নরম-সরম লোকেদের বিশেষ কেউ পছন্দ করেন না। অন্তত এ দেশে।
বাঁচতে গেলে একটা শক্তপোক্ত ধর্মীয় অনুশাসন লাগে। বিতর্ক থাক বা না থাক, সেই অনুশাসন অসহিষ্ণুতার উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। যাঁদের ধর্মের প্রয়োজন নেই, অধুনা তাঁদের কাছে পার্টিই ঈশ্বর। পার্টি লাইন থেকে এ দিক ও দিক করলেই ঘাড়ধাক্কা। এই জন্যই মুনমুন সেনকে ভাল লাগছে। পার্টি লাইনের তোয়াক্কা না করেই কেমন বলে দিলেন ব্যক্তিগত মতামত।
আমার চিরকালই একটু দ্বিধাগ্রস্তদের বেশি ভাল লাগে। মনে হয়, তাঁদের মধ্যেই নতুন চিন্তার কিছু উপাদান আছে। ধর্মে বা পার্টি লাইনে কট্টরপন্থীরা বরাবরই নতুন পথের বিরোধী। সর্বদাই ত্রস্ত, এই বুঝি কৌমার্য ভঙ্গ হল। অথচ সংসার, রাজনীতি, ধর্ম, কোথাওই তো অবিমিশ্র বলে কিছু হয় না। একের মধ্যে অনেকের ওঠাপড়াই জীবন। উদারপন্থার কথা বলতে ভাল লাগে, কিন্তু তাকে সত্য বলে মেনে নিয়ে চলা শক্ত। তার চাইতে অসহিষ্ণুতার অনেক সহজ। কতকগুলো পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা অভ্যাসকে এক সূত্রে গেঁথে একটা লাইন তৈরি করে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। গালিগালাজ দিয়ে, মারামারি করে দিব্যি কেটে যায়।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। গত বছর এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ খাগড়াগড় কাণ্ড নিয়ে উত্তাল। বেআইনি অনুপ্রবেশ, সন্ত্রাস ও অবৈধ মাদ্রাসার যোগসূত্র নিয়ে আমরা প্রচণ্ড ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় একটি পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে লেখা হয়, এ ভাবে কোনও সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা উচিত নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি হলে অনুপ্রবেশ ঠেকানো সহজতর হবে, ইত্যাদি। প্রতিবেদনের লেখককে পরে এ জন্য সমালোচনা শুনতে হয়েছিল, সেই সমালোচনার সার কথা: ‘এ তো তৃণমূলের লাইন!’ এটা সহিষ্ণুতা?
আসলে আমাদের সর্বদা একটা লাইন না হলে চলে না। ধর্মে বা জিরাফে বা রাজনীতিতে নেতা ঠিক করে দেবেন কী করা উচিত। আমরা সেই অনুযায়ী চলব। নিদেনপক্ষে কতকগুলো কেতাব থাকবে যা দেখে অনুচ্ছেদ টুকে টুকে জীবন কাটাব। একাকী ভাবনাচিন্তা করার চাইতে দলবদ্ধ জীবন অনেক সুখের। অন্য দলের উপর সব দোষ চাপিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর তালে থাকা শরীর ও মনের পক্ষে আরামদায়ক। মুনমুন অন্তত এটুকু বলতে চেয়েছেন যে অসহিষ্ণুতার একটা ধরন হয় না। কখনও নরম অসহিষ্ণুতা, কখনও বা চরম।
তা হলে উপায়? মুনমুন বলেছেন, ‘পাঁচ বছর সময় আছে। প্রধানমন্ত্রী ভাল কাজ করতেও পারেন। তাঁকে সুযোগ দেওয়া হোক। তাঁর দলই তাঁকে কাজ করতে দিচ্ছে না।’ দেশ জুড়ে চরম অসহিষ্ণুতার আবহে এমন কথাবার্তা বেখাপ্পা লাগে ঠিকই। সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধই যেখানে নিয়ম, সেখানে এই বেনিয়ম কেন? কেন প্রধানমন্ত্রীকে ভাল কাজ করতে বলা হচ্ছে? কেন দলকে সহিষ্ণু হতে বলা হচ্ছে? বিজেপি আবার সহিষ্ণু হবেই বা কী করে?
প্রতিবাদীদের মহত্ত্বকে স্বীকার করে নিয়েই বলা যায় যে, একটা নির্ভরযোগ্য বিকল্প না দিতে পারলে শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার জোরে এই অসহিষ্ণুতাকে কাবু করা যাবে না, বরং তাতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আরও তৎপর হবে, সামাজিক মেরুকরণের প্রবণতা বাড়বে, অন্ধকারের উপাদানগুলি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে। মনে রাখা ভাল, সামাজিক বাস্তব এমনই যে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার রাজনীতি সমাজে অধিকতর শক্তিশালী। তাই বলব, ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হোক বিকল্প রাজনৈতিক দাবি। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের দাবিতে দেশ জুড়ে আন্দোলনের প্রয়োজন। তবেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যুক্তিগুলি খেই হারিয়ে ফেলবে, সংঘ পরিবারের অগ্রাধিকারগুলি তাদের গুরুত্ব হারাবে। প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে হবে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা। মনে করাতে হবে তাঁর দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়ে তাঁর সাড়ম্বর অঙ্গীকারগুলি। তাঁর সরকারের মেয়াদ এখনও সাড়ে তিন বছর বাকি। এই মুহূর্তে তাঁকে গদিচ্যুত করা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের বাঁচতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে।
দেশের সরকার, শাসক দল যদি বিপথগামী হয়, তবে গণতন্ত্রে নাগরিকের কর্তব্য তাকে সংযত হতে বলা। সংযমের পথটাও বাতলে দেওয়া। উপাদানগুলি চিনিয়ে দেওয়া। দরকারে পার্টি লাইন ছেড়ে সংবিধানের অনুগামী হতে বলা। দেবালয়ের তুলনায় শৌচাগারের প্রয়োজনের কথা মনে করিয়ে দেওয়া। নয়তো শুধুমাত্র মহাশূন্যে কিল মেরে নিজেদের হাত ব্যথা করিয়ে লাভ নেই।
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy