Advertisement
E-Paper

কিন্তু জয় কিসান?

ভগীরথ, মনোজ, জয়মল, সুব্রহ্মণ্যন—চার জনের সংসারের ছবিটা অনেকটা একই রকম। চার জনই গরিব পরিবার থেকে উঠে এসে চাকরি করে সংসারের হাল ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯ ০১:৪৫

মা-মরা ছেলে ভগীরথকে চাষের রোজগার থেকেই বড় করে তুলেছিলেন রাজস্থানের জৈতপুর গ্রামের পরশুরাম সিংহ। ওড়িশার মনোজ বেহরার বাবা, ৬৫ বছরের জিতেন্দ্র এখনও চাষাবাদ করেন, যাতে সংসারে আর একটু পয়সা আসে। জয়মল সিংহের বাবা যশোবন্তের নিজের জমিজিরেত ছিল না, তাই পঞ্জাবের গ্রামে ঘুরে ঘুরে দুধ বেচেই ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছিলেন তিনি। ২৭ বছরের জি সুব্রহ্মণ্যন ছুটিতে তামিলনাড়ুর সভলাপেরি গ্রামের বাড়িতে ফিরলে, নিজেই চাষের জমিতে নেমে পড়তেন।

ভগীরথ, মনোজ, জয়মল, সুব্রহ্মণ্যন—চার জনের সংসারের ছবিটা অনেকটা একই রকম। চার জনই গরিব পরিবার থেকে উঠে এসে চাকরি করে সংসারের হাল ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন।

আরও একটা মিল রয়েছে তাঁদের। ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় সিআরপি-র কনভয়ে জঙ্গি-হামলায় চার জনই নিহত হন।

পুলওয়ামায় জইশ-ই-মহম্মদের হামলা, তার জবাবে নরেন্দ্র মোদীর পাকিস্তানের বালাকোটে প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত বিজেপির বিরোধী শিবিরের নেতাদেরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় তাঁরা সরকারের পাশে এককাট্টা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বালাকোটে জঙ্গি শিবিরে হানার জন্য বায়ুসেনাকে তাঁরা কুর্নিশ করছেন। সেটাই কাম্য। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা হাহুতাশ করছেন— দেশপ্রেম-জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আর সব প্রশ্ন ধামাচাপা পড়ে গেল!

কিন্তু তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন করা দরকার— কেন? ‘জয় জওয়ান’-এর সঙ্গে ‘জয় কিসান’-এর কি আদৌ কোনও বিরোধ রয়েছে? নেই। পুলওয়ামায় নিহত সিআরপি-র ৪০ জন জওয়ানের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিলেই বিরোধী নেতারা জানতে পারতেন, তাঁদের অধিকাংশই গ্রাম বা মফস্সলের গরিব পরিবারের সন্তান। কৃষক, খুব বেশি হলে ছোট ব্যবসায়ী, সাধারণ চাকুরের ছেলে। রুটিরুজির প্রশ্ন তুললে, চাষিদের সমস্যার কথা বা নোট বাতিলের পর ছোট ব্যবসায়ীদের দুর্দশার কথা বললে, এই সব পরিবারের পাশেই দাঁড়ানো হয়। কিন্তু বিরোধীরা কেমন গুটিয়ে গেলেন। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় সরকারের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমজনতার রুটিরুজির প্রশ্নও তুলতে ভুলে গেলেন।

বিরোধীরা গত কয়েক দিনে একটু নড়েচড়ে বসেছেন বটে। আলোচনা চলছে, কী ভাবে মোদী জমানায় চাকরির অভাব, চাষিদের দুর্দশা, ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের মতো বিষয়কেও ফের তুলে ধরা যায়। রাহুল গাঁধী নিজে ফের রাফাল, গরিবদের সমস্যা নিয়ে সরব হচ্ছেন। কিন্তু বালাকোটে কত জঙ্গি মারা গেল, জইশ-প্রধান মাসুদ আজহার বিপাকে পড়ল কি না, সেই সব বিতর্কের তুলনায়, মানুষের রুটিরুজির সমস্যা তুলে ধরতে এখনও তাঁদের যেন বেশ ইতস্তত ভাব। বিরোধীরা হয়তো ভয় পাচ্ছেন, আইএসআই ও মাসুদ আজহারের মুন্ডুনিপাত ছাড়া আর কোনও কথা বললেই তাঁদের গায়ে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’-এর তকমা লেগে যাবে।

অথচ প্রশ্নগুলো হাতের সামনেই মজুত। গবেষণা সংস্থা সিএমআইই-র রিপোর্ট জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে দেশে বেকারত্বের হার ৭.২ শতাংশ ছুঁয়েছে। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরের পরে যা সব থেকে বেশি। তা নিয়েও বিরোধীরা রাস্তায় নেমেছেন কি? মোদী সরকারের পরিসংখ্যান দফতরই ২০১৮-র অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের আর্থিক বৃদ্ধির হিসেব প্রকাশ করে জানিয়েছে, কৃষি ক্ষেত্রের ছবিটা খুব খারাপ। দেশের ৪৭ শতাংশ খেটেখাওয়া মানুষের চাষাবাদই ভরসা। তাঁদের আয় কমলে দেশের দারিদ্র বাড়বেই। কিন্তু এ নিয়ে বিরোধীদের বিশেষ সরব হতে দেখা গেল না এখনও।

নরেন্দ্র মোদী সে ভুল করছেন না। তিনি জানেন, ভোটে জিততে ‘জয় জওয়ান’, ‘জয় কিসান’ দুটোই প্রয়োজন। ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার হামলার দশ দিন পরেই তাই নরেন্দ্র মোদী গোরক্ষপুরে আবির্ভূত হলেন। প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি-তে চাষিদের জন্য নগদ টাকার প্রকল্প নিয়ে। গরিব চাষিদের জন্য ভোটের আগে তাঁর উপহার। গোরক্ষপুর শুধু যোগী আদিত্যনাথের দুর্গ নয়। প্রধানমন্ত্রীর নিজের লোকসভা কেন্দ্র বারাণসী থেকে তার দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার। দু’টি স্থানই পূর্ব উত্তরপ্রদেশে। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব নিয়েই প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা রাজনীতির মাঠে নেমেছেন। পাঁচ বছর আগে গোরক্ষপুরে লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়েই মোদী বলেছিলেন, উত্তরপ্রদেশে গুজরাতের মতো ‘উন্নয়ন’-এর জোয়ার আনতে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি চাই।

বাস্তবে কী হয়েছে? নমুনা মিলল পুলওয়ামার হামলার ঠিক এক সপ্তাহ পরে নাশিকের বোম্বে নাকা চকে। হাজার দশেকের বেশি চাষি, ভূমিহীন কৃষক, খেতমজুর জড়ো হয়েছিলেন। লক্ষ্য, ফের সাত দিন পায়ে হেঁটে মুম্বই। কিসান লং মার্চ, দ্বিতীয় অধ্যায়। মনে রাখতে হবে, আদিবাসীদের সিংহভাগই গত বছর মার্চ মাসেও ফসলের নায্য দাম, জমির পাট্টার দাবিতে লং মার্চে হেঁটেছিলেন। দু’দিনের মাথাতেই মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার চাষিদের সব দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে যাত্রা চাষিদের ঘরে ফেরান। কিন্তু সমস্যা যে মেটেনি, এই দ্বিতীয় অধ্যায় তার প্রমাণ।

এর ফলে প্রমাণ হয়েছে আর একটা বিষয়ও। পুলওয়ামায় জওয়ানদের উপর হামলা, তার পাল্টা জবাব দিতে নরেন্দ্র মোদীর রণহুঙ্কার, এ সবের মধ্যে গরিব মানুষ পেটের দায়ে রাস্তায় নেমেছেন। পাকিস্তানকে গালমন্দ করে, জওয়ানদের বীরত্বের গল্প শুনে, খালি পেটে নিশ্চিন্ত ঘুম আসেনি তাঁদের।

আর সেই কারণেই এত কাণ্ডের পরেও নরেন্দ্র মোদী নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। তিনি জানেন, তাঁর জমানায় চাষিদের ক্ষোভ তুঙ্গে। তাঁর আচমকা নোট বাতিলের ধাক্কা চাষিরাও খেয়েছেন। তিনি চাষিদের আয় দ্বিগুণ করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, বাস্তবে চাষিদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। অতএব তাঁকে উপহার নিয়ে দৌড়তে হয়েছে।

৫৪ বছর আগে ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’ স্লোগান দিয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তখন চাষিদের ক্ষোভ এমন তুঙ্গে ছিল না। শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই পাকিস্তান হামলা করে। তার সঙ্গে দেশে খাদ্য সঙ্কট। জওয়ানদের জয়গান গেয়ে চাষিদের ফলন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন শাস্ত্রী। দিল্লির রামলীলা ময়দান থেকে শাস্ত্রীর সেই স্লোগান সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সেই স্লোগান পরে বিজেপির দুই প্রধানমন্ত্রীর মুখেই শোনা গিয়েছে। পোখরানের পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পর অটলবিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন, জয় জওয়ান, জয় কিসান, জয় বিজ্ঞান। আর ফেব্রুয়ারি মাসেই জালন্ধরে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী স্লোগান দিয়েছেন, ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান, জয় বিজ্ঞান, জয় অনুসন্ধান’।

নরেন্দ্র মোদী একই সঙ্গে জওয়ান ও কিসানের জয়গান গাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিসানের সন্তানরাই সেনা, আধাসেনা বাহিনীর নিচুতলার জওয়ান। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘জয় জওয়ান’ তো হল। ‘জয় কিসান’-এর কী হল?

Pulwama Terror Attack Farmer CRPF Jawan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy