Advertisement
E-Paper

মনোরোগী মানেই অক্ষম নন

এই ঘটনাটা সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘ভাইরাল’ হয়ে উঠেছিল। স্বামী বা ভাই কি মহিলাকে ত্যাগ করে ঠিক করেছে? এক পক্ষের মত: কাজটা অমানবিক। ঘর, স্বামী, সন্তানের থেকে এ ভাবে একটি মেয়েকে কি সরিয়ে দেওয়া যায়? অন্য পক্ষের বক্তব্য: উপায় কী?

রত্নাবলী রায়

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০

বা‌ংলার শিল্পসংস্কৃতি জগতে পরিচিত এক ব্যক্তির মাঝবয়সি কন্যাকে কিছু দিন আগে বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল বাইপাসের ধারে। মহিলা বিবাহিতা, সন্তানও আছে। কিন্তু মনোরোগে আক্রান্ত বলে স্বামী ঠেলে দেন বাপের বাড়িতে। কিছু মাসোহারা পাঠান, কিন্তু সন্তানকে দেখতে দেন না। স্বামীর দাবি, সন্তান মাকে ভুলে গিয়েছে। বাবার নতুন জীবনসঙ্গীকেই সে ‘মা’ বলে চেনে। আন্দাজ হয়, বাপের বাড়িতেও মহিলার দশা ছিল তথৈবচ। তাই রাস্তায় পাওয়া গেল। ভাই দিদিকে ঘরে ফেরাতে রাজি নন। যুক্তি, আর এক মনোরোগী দাদা তাঁর সঙ্গে থাকেন। আর দিদি তো ভবঘুরে আশ্রমে শান্তিতে আছে।

এই ঘটনাটা সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘ভাইরাল’ হয়ে উঠেছিল। স্বামী বা ভাই কি মহিলাকে ত্যাগ করে ঠিক করেছে? এক পক্ষের মত: কাজটা অমানবিক। ঘর, স্বামী, সন্তানের থেকে এ ভাবে একটি মেয়েকে কি সরিয়ে দেওয়া যায়? অন্য পক্ষের বক্তব্য: উপায় কী? মনোরোগী কি ছেলে মানুষ করতে পারেন? না কি তাঁকে নিয়ে কেউ ঘর করতে পারেন?

কাউকে আঘাত করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বরং বলতে চাই, ঘটনাটি বেশি আলোচিত হলেও, ব্যতিক্রমী নয়। মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করতে গেলে এমন ঘটনা বার বার সামনে আসে। সাধারণ বুদ্ধিতে একটু অবাক লাগে। কেন এই সব প্রশ্ন? যদি কারও দেহের অসুখ করে, পরিবার ঘটিবাটি বেচেও চিকিৎসার করান। তাঁকে ঘর থেকে বার করার কথা কেউ মুখেও আনেন না। অথচ মনোরোগীর চিকিৎসা না করিয়ে বার করে দেওয়াই স্বাভাবিক মনে হয়। সেই পুরনো ধারণা, পাগলের আবার চিকিৎসা কী?

অথচ ঘটনা হল, অধিকাংশ মনোরোগী যথাযথ চিকিৎসায় সুস্থ, কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যা উন্নতি হয়েছে, তাতে জটিল মনোরোগও প্রায় আশি শতাংশ সেরে যায়। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে বেশি শর্করা নিয়েও আমরা স্বাভাবিক জীবন কাটাই। তেমনই মনোরোগীরও কিছু রোগলক্ষণ থেকে যেতে পারে। কিন্তু তাতে তাঁর জীবনযাপন, দায়িত্বপালন ব্যাহত হয় না। আমার অনেক বন্ধু আছেন, যাঁরা নিয়মিত ‘কথা’ শোনেন। তাঁরা নিজেদের ‘ভয়েস হিয়ারিং পার্সন’ বলেন এবং নিজেদের সংগঠিতও করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের জীবন, সংসার, প্রেম, সন্তান, সম্পত্তি ঠিকই ম্যানেজ করছেন।

অথচ মানসিক রোগ হলেই তাঁকে দাগিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর থেকে সন্তান কেড়ে নেওয়া হয়, তাঁকে ‘অযোগ্য’ প্রমাণ করে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়। এই ভদ্রমহিলাকেও সন্তানের থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে, পরিবার থেকেও। স্বামী, ভাই, সন্তান থাকা সত্ত্বেও তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, ভবঘুরের আশ্রমে স্থান পেলেন, এটা কি মানা যায়? যে কোনও অসুস্থ মানুষের সেবা, যত্ন এবং চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। তা থেকে বঞ্চনা মানেই অত্যাচার।

মনোরোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও বিদ্বেষের সঙ্গে যখন নারীবিদ্বেষ যোগ হয়, অত্যাচার আরও চরমে ওঠে। তাকে আর অন্যায় বলে বোধও হয় না। ভাই বলেছেন, দিদি ভবঘুরে আশ্রমে ‘শান্তি’তে আছেন। এই শান্তি কার শান্তি? ভাইয়ের মনে শান্তি হতে পারে, যে দিদি নিরাশ্রয় ভিখিরি হওয়ার দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা পেয়েছেন। অথচ আর এক মনোরোগী দাদা ছোট ভাইয়ের সঙ্গেই আছেন পৈতৃক বাড়িতে। অর্থাৎ পুরুষ সন্তান বাবার বাড়িতে থাকতে পারেন, কিন্তু কন্যাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও।

স্বামীর দাবি, তাঁর সন্তান মনোরোগী মাকে ভুলে গিয়েছে। আন্দাজ হয়, এই ভুলিয়ে দেওয়ার কাজটা খুব ছক কষে করা হয়েছে, এটা পরিকল্পিত হিংসা। শিশুদের অনুভব তীক্ষ্ণ হয়। তারা বোঝে কোন কথাটা জিজ্ঞাসা করা যায়, আর কোনটা এড়িয়ে যেতে হবে। তা বলে তারা সত্যিই ভোলে না। আমার বন্ধু ঝিলমিলের ক্ষেত্রে এমনই ঘটেছিল। ঝিলমিলের মনোরোগ হয়েছে, এই অপবাদ দিয়ে স্বামী চার সন্তান নিয়ে বিদেশে চলে যান। তখন বড় ছেলেটি দশ বছরের ছিল। বড় হয়ে সে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে, এখনও তা রেখেছে।

মনে রাখা দরকার, মনোরোগ দেখা দিলেই এক জন অক্ষম হয়ে যান না। ‌লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাব এমন অনেক মাকে, যিনি নানা মানসিক সমস্যা সত্ত্বেও সন্তানকে আদরযত্নে মানুষ করছেন।

আসলে বহু ক্ষেত্রে মনোরোগ সম্পর্কে সমাজের ভয় আর বিদ্বেষকে লোকে কাজে লাগায় নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে। বিবাহবিচ্ছেদ পাওয়ার, সন্তানের অধিকার বা সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চনা করার সহজ উপায় ‘মনোরোগী’ সাব্যস্ত করা। আসলে অক্ষমতা স্বামী, বাবা-মা, ভাই-বোনেদের। তাঁরা ভালবাসতে পারেননি ওই মেয়েটিকে।

কারও দেহে কোনও আঘাত লাগলে আমরা তার কারণ জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অথচ কেন এক জন সুস্থ মানুষ মনোরোগী হয়ে পড়লেন, তা নিয়ে একটুও চিন্তা করি না। কোনও মানুষকে কিছু দিন নির্যাতনের পরিস্থিতিতে রাখা হলে তাঁর মানসিক সমস্যা তৈরি হবেই। অনেক সময়ে সুপরিকল্পিত নির্যাতনের মাধ্যমেও মানসিক স্থিতি নষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু মনোরোগী বলে ত্যাগ করার আগে আদৌ কি কারণ খুঁজে বার করার চেষ্টা হয়?

মানসিক হাসপাতালে কাজের সুবাদে এমন অনেক মানুষের বাড়িতে গিয়েছি, যাঁরা দশ-বারো বছরে এক বারও আত্মীয়কে হাসপাতালে দেখতে যাননি। কেন হাসপাতালে রেখেছেন, প্রশ্ন করলে বলেছেন, ‘‘পাগল মানুষের সঙ্গে তো আর এক বাড়িতে বসবাস করা যায় না!’’ আসলে অসুস্থ মানুষকে একঘরে করে, সমাজ-সংসার থেকে উপড়ে পাগলাগারদে ভরে দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। নিজের ‘শান্তি’ খুঁজে নিই।

Mental Patient Treatment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy