Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

মাতৃদিবস

অতি দূরের বস্তু যেমন নজরে আসে না, তাহা অতি সন্নিকট হইলেও তেমনই নজর এড়াইয়া যায়। ভারতে মাতৃবন্দনার ধুমধামের আড়ালে আছে মায়ের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলার করুণ সত্যটি। বৃন্দাবনে যাঁহারা ভিক্ষা করিয়া জীবনধারণ করেন, তাঁহারা অনেকেই সন্তানের মা।

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

অতি দূরের বস্তু যেমন নজরে আসে না, তাহা অতি সন্নিকট হইলেও তেমনই নজর এড়াইয়া যায়। ভারতে মাতৃবন্দনার ধুমধামের আড়ালে আছে মায়ের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলার করুণ সত্যটি। বৃন্দাবনে যাঁহারা ভিক্ষা করিয়া জীবনধারণ করেন, তাঁহারা অনেকেই সন্তানের মা। বয়স বাড়িলে ভারতে মহিলারা অত্যন্ত বিপন্ন হইয়া পড়েন। সন্তানের সংসারে যাঁহারা বাস করেন, তাঁহাদেরও অসুস্থতার চিকিৎসা হয় বিলম্বে, অথবা হয় না। বিশেষত ব্যয়সাধ্য চিকিৎসাগুলি এড়াইয়া যাওয়া হয়। নানা সমীক্ষায় প্রকাশ, বৃদ্ধারা নিঃসঙ্গতায় ও একাকিত্বে ভুগিতেছেন, এবং প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হইয়া বাঁচিয়া আছেন। একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় প্রকাশ, দশ জন বৃদ্ধার চার জনই নিয়ত গালমন্দ শুনিয়া থাকেন, দশ জনে তিন জন অবহেলার শিকার। সম্পত্তির অধিকার নাই, স্বাধীন রোজগারের উপায়ও নাই, সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পগুলিতে স্থান নাই বলিলেই চলে। অতএব মাতা ও মাতৃসমাদের কথা ভাবিবার জন্য একটি দিবস বরাদ্দ করিয়া ভুল হয় নাই। ভারতে মায়েদের সুরক্ষিত ও সুখী জীবন নিশ্চিত করিতে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত সুচিন্তার প্রয়োজন আছে। সন্তানদের চাহিদা মিটাইতে যাঁহারা জীবনের একটি বড় অংশ ব্যয় করিয়াছেন, পরবর্তী প্রজন্ম তাঁহাদর চাহিদা মিটাইতে কী করিতেছে, বৎসরে এক দিন সেই চিন্তা করিতে হইবে বইকী।

প্রশ্ন কেবল বৃদ্ধার নিরাপত্তার নহে। অকালমাতৃত্ব, অনিচ্ছা-মাতৃত্বও নজর এড়াইতে চাহে। সন্তানের জন্য শারীরিক বা মানসিক ভাবে প্রস্তুত হইবার পূর্বেই গর্ভধারণ, ইহা ভারতের এক পরিচিত সমস্যা। মাতৃত্বকে মূল্যবান করিয়া মেয়েদের অবমূল্যায়নের পুরাতন রীতিটিও দুর্মর। জাতীয় সমীক্ষায় প্রকাশ, আটত্রিশ লক্ষ মেয়ে কৈশোর পার হইবার পূর্বেই সন্তানের জন্ম দিয়াছে। তাহাদের মধ্যে চোদ্দো লক্ষ কুড়ি ছুঁইবার পূর্বেই একাধিক সন্তানের মা। অপুষ্টি ও রক্তাল্পতা মা ও শিশু উভয়কেই বিপন্ন করিয়া ফেলে, তাহা বহু আলোচিত। কিন্তু মায়ের স্কুলশিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকিবার যে মানসিক ও সামাজিক ক্ষতি, তাহার হিসাব কেহ করে না। অকালমাতৃত্বের জন্য বলিপ্রদত্ত কন্যাসন্তানের জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগও করে না পরিবার। কিশোরী মায়েদের প্রায় অর্ধেকই যে অক্ষরপরিচয় হয় নাই, তাহা কাকতালীয় নহে।

মাতৃত্ব বহু মেয়ের জীবনে পূর্ণতার প্রতিশ্রুতি লইয়া আসে না। উপযুক্ত মানসিকতা প্রস্তুত হইবার পূর্বেই সন্তানপালনের দায়িত্ব তাহাদের উপর চাপিয়া বসে। মাতৃত্বের জয়ধ্বনিতে এই কিশোরীদের দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়িয়া যায়। মাতৃত্ব মূল্যবান বলিয়াই তাহাকে একটি জৈবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত করিবার চেষ্টা নিন্দনীয়। মেয়েদের নিজেদের দেহ ও জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ কাড়িয়া লইয়া মাতৃত্ব আরোপের যে বিপজ্জনক প্রবণতা শুরু হইয়াছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই মহিলারা তাহার প্রতিবাদে মুখর। ভারতের আইন জন্মনিয়ন্ত্রণ বা গর্ভপাতের বিষয়ে উদার, কিন্তু সরকারি ব্যবস্থা কিশোরীদের গর্ভধারণ সংক্রান্ত তথ্য-পরিষেবা সরবরাহে নারাজ। তাই জীবনশৈলী শিক্ষার বিষয়টি স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হইলেও তাহাকে ফের শ্রেণিকক্ষের বাহিরে খেদাইয়া দেওয়া হইল। অশিক্ষা অপুষ্টি, অক্ষমতায় সফল মাতৃত্বের সূচনা হইতে পারে না। মাতৃদিবস আহ্লাদে অপচয় না করিলেও হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mothers day celebration Oath
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE