Advertisement
E-Paper

সম্পত্তি চায় মুসলিম মেয়েরাও

ভারতে মুসলিম মেয়েরা যে পারিবারিক আইনের সংস্কার চায়, তা শুধু তালাক প্রথা রদ করার জন্য নয়। তার অন্যতম কারণ: সম্পত্তির অধিকার।

আফরোজা খাতুন

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

লতীফ শৈশবে পিতৃহীন হইয়াছেন। পিতামহ বর্তমানে পিতার মৃত্যু হওয়ায় তিনি ও তাঁহার ভগিনীদ্বয় রশীদা ও রফীকা সম্পত্তির অংশে বঞ্চিত হইলেন। ...লতীফের মাতা অতিশয় বুদ্ধিমতী রমণী ছিলেন... তিনি দাসীর অধম হইয়া ভাশুর-পত্নীর মনোরঞ্জন করিতে লাগিলেন।’’

প্রায় একশো বছর আগে রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪) উপন্যাসে জমিদার বাড়ির গৃহবধূ লতীফের মা দাসত্ব স্বীকার করেছিলেন যে কারণে, সেই কারণেই আজও দাসীর জীবন বাঁচতে হচ্ছে বহু মেয়েকে। উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত মুসলিম বিধবা। ভারতে মুসলিম মেয়েরা যে পারিবারিক আইনের সংস্কার চায়, তা শুধু তালাক প্রথা রদ করার জন্য নয়। তার অন্যতম কারণ: সম্পত্তির অধিকার।

দুই সন্তান নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন বাঁকুড়ার সাহেস্তা বিবি। মেয়ের বয়স দশ বছর, ছেলের ছ’মাস। শ্বশুর বেঁচে ছিলেন। ইসলামিক আইন অনুযায়ী, বাবার আগেই ছেলের মৃত্যু হলে তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা ঠাকুরদার সম্পত্তির অংশীদার হয় না। মৃত ছেলের সম্পত্তির ভাগটা চলে যায় বাবার অন্য সন্তানদের কাছে। অথচ মৃত ছেলের নামে কোনও সম্পত্তি থাকলে জীবিত বাবা তার শরিক হন। শ্বশুরের দয়ায় (অধিকারে নয়) সাহেস্তা বিবি সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই পান। গত জুলাই মাসে মারা যান তিনি। ছেলেকে শরিকরা বুঝিয়ে দিয়েছে, এ বার বাড়ি ছাড়তে হবে। পঞ্চায়েত থেকে বিডিও অফিস, কেউ সাহায্য করতে পারেনি। তার বাবার অংশ ভোগ করছে কাকার পরিবার।

সাতাশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছেন রোজিনা খাতুন, কোলে দেড় বছরের শিশু। শ্বশুরবাড়ি বাঁকুড়ায়, যথেষ্ট সম্পত্তি রয়েছে। শিশুটিকে কিছু সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য গ্রামের মানুষ রোজিনার শ্বশুরের কাছে আবেদন করেন। শ্বশুর শরিয়ত দেখিয়ে বিদায় দিয়েছেন। রোজিনা আপাতত বাবার আশ্রয়ে। সেলাইয়ের কাজ শিখছেন। সন্তানকে খাওয়াতে হবে যে। আঠারো বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দু’বছরের সন্তান নিয়ে মুর্শিদাবাদের ফরিদা বেগম বিতাড়িত হন স্বামীর বাড়ি থেকে। বাবার সামর্থ্য নেই, দাদাদের সংসারে ফিরতে হয়।

রোজিনা, ফরিদারা এ বার চাইছেন, শরিয়তের নামে মেয়েদের সর্বস্বান্ত করা রুখতে আইন হোক। আইনের দাবিতে লড়াইয়ে শামিল হওয়ার জন্যও তাঁরা প্রস্তুত। কারণ তাঁরা খবর পেয়েছেন, শ্বশুরের জীবদ্দশায় স্বামীর মৃত্যু হলে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তানের রোজিনাদের বার করে দেওয়া যায় না। সে সব দেশের পারিবারিক আইন মোতাবেক মেয়েরাও সম্পত্তির অংশীদার। আগেই আইনের সংস্কার হয়েছে সেখানে। এ দেশে হবে না কেন?

১৯৬১-তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ জারি করেন। তাতে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে ‘লা-ওয়ারিশ’ প্রথাকে বাতিল করা হয়। এই আইন অনুযায়ী, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের পূর্বে মৃত ব্যক্তির কোনও পুত্র বা কন্যার মৃত্যু হলেও, সম্পত্তি বণ্টনের সময়ে সেই মৃত সন্তানের জীবিত পুত্রকন্যারা সম্পত্তি পাবেন। এটা বাংলাদেশেও চালু আছে।

মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছে এ দেশেও। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বহু নাগরিকের স্বাক্ষর-সংবলিত একাধিক দাবিতে স্মারকলিপিও জমা পড়েছে বিভিন্ন সময়। এই দাবিগুলি হল— মৌখিক তালাক, বহু বিবাহ ও হালালা বিয়ে বন্ধ করতে হবে, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকার দিতে হবে, শ্বশুরের জীবদ্দশায় স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা পুত্রবধূ ও তাঁর সন্তানদের সম্পত্তির অধিকার দিতে হবে, দত্তক গ্রহণের এবং দত্তক সন্তানকে সম্পত্তির অধিকার দিতে হবে।

এতগুলো দাবিতে অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা সরব হলেও, একমাত্র তালাক সমস্যা নিয়েই শোরগোল পড়েছে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের দাবিতে মুসলিম মহিলারা যখন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছোতে বাধ্য হলেন তখন টনক নড়ল মুসলিম পুরুষতন্ত্রের। ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ’ এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে চাইলেন তাঁরা। কিন্তু এর ব্যবহারিক প্রয়োগে মেয়েরা যে সমস্যায় পড়ছেন, তাকে রোধ করার তৎপরতা দেখালেন না। এটাই সুবিধা করে দিল হিন্দুত্ববাদীদের। মুসলিম মেয়েদের রক্ষা করার নামে আন্দোলনের শরিক হয়ে উঠতে চাইল আরএসএস, বিজেপি। এই গৈরিক আগ্রাসনে চাপা পড়ে গেল মুসলিম মেয়েদের লিঙ্গসাম্যের দাবি। এটা শেষ পর্যন্ত মুসলিম মৌলবাদ বনাম হিন্দু মৌলবাদের লড়াইয়ের চেহারা নিল। মেয়েদের সক্ষমতার ভাবনার সঙ্গে যার দুস্তর ব্যবধান।

উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে মুসলিম মেয়েদের সমান অধিকার নেই। ‘ইসলাম প্রথম মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দিয়েছে’ এই ভাষ্যে গর্ব থাকলেও, আজকের প্রেক্ষিতে বঞ্চনা ও অসম্মানের প্রশ্ন প্রকট। ছেলেরা পায় বাবার সম্পত্তির তিন ভাগের দু’ভাগ, মেয়েরা এক ভাগ। আবার কোনও দম্পতির যদি শুধু কন্যা থাকে তা হলে তাঁদের সম্পত্তির কিছুটা অংশ নিকট আত্মীয়রা পাবেন। কিন্তু পুত্র-কন্যা উভয়েই থাকলে সম্পত্তি পরিবারের বাইরে বেরোবে না।

এ এক বিরাট বৈষম্য। পুত্রেরা সন্তানের পুরো অধিকার পেলে, মেয়েরা পাবেন না কেন? তার মানে মেয়েদের সম্পূর্ণ সন্তান হিসেবে দেখা হচ্ছে না। এই অপমান শুধু মেয়েদের নয়। পুত্রের জন্ম দিতে না পারা বাবা-মায়েরও। তাঁরা অসহায়। যাঁরা মেয়ের সম্পত্তিতে বাইরের লোককে ভাগ বসাতে দিতে চান না, তাঁরা তা লিখে দেন মেয়েদের নামে। অতঃপর তাঁদের উপর চলে মানসিক পীড়ন। কতটা শরিয়ত-বিরোধী কাজ হয়েছে, সে কথা নিয়ত জানান দিতে থাকেন আত্মীয়রা। এক দিকে ধর্মভীতি, অপর দিকে সন্তান-স্নেহ। মৃত্যু পর্যন্ত এই মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটে তাঁদের। পুত্রের জন্ম দিতে ব্যর্থ পিতামাতা যে তাঁরা!

মেয়েরা যে গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধ করতে পারেন না, তার একটা প্রধান কারণ তাদের সম্পত্তিহীনতা। ২০১৫ সালে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মুসলিম মেয়েদের বিরাশি শতাংশের কোনও সম্পত্তি নেই। যাঁদের সম্পত্তি আছে, তাঁরাও অধিকাংশ পেয়েছেন স্বামীর কাছ থেকে। বাবার সম্পত্তি পেয়েছেন, এমন মেয়ে নগণ্য।

ভারতের প্রতিটি নাগরিক আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। সংবিধানের চোদ্দো নম্বর ধারা তেমনটাই বলে। কিন্তু মুসলিম মেয়েদের পারিবারিক সমস্যাকে ব্যক্তি-নাগরিকের সমস্যা বলে গণ্য না করে, সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে রেখে বিচার করা হয়। এর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করছে মেয়েরা। এর বিরুদ্ধেই আন্দোলন। লড়াই জারি রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নির্বাচনী মুনাফা-গোনা রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধেও।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন-এর

বাংলার শিক্ষক

Muslim Women Property Muslim personal law in India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy