Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিভা

‘মোদী ম্যাজিক’ যদি কোথাও থাকে, তবে তাহা এই দৃশ্যনির্মাণের দক্ষতায়। যে কোনও মুহূর্তকে শেষ অবধি অধিকার করিয়া লওয়ার, নিজস্ব মুহূর্তে পরিণত করিবার প্রতিভায়।

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

ইসরো-র চেয়ারম্যানের চোখে জল ছিল কি না, সেই তর্কের মীমাংসা হওয়া মুশকিল। কিন্তু, ভারতীয় হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর আলিঙ্গনাবদ্ধ হইবার বিরল সুযোগ পাইলেন তিনি, তাহা প্রশ্নাতীত। অনেকেই বলিতেছেন, কে শিবন নিমিত্তমাত্র— প্রধানমন্ত্রী ও ক্যামেরার অসামান্য সমীকরণে তিনি বড় জোর অনুঘটক। ইসরো-র অভিযানটি সম্পূর্ণ সফল হইলে তাহা সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম একশত দিন পূর্তির সহিত সমাপতিত হইত। নিছক সমাপতন কি না, সেই সংশয় উহ্যই থাকুক। কিন্তু, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার এই সাফল্যটির দ্যুতি সরকারের প্রথম একশত দিনের গায়ে আসিয়া পড়িত, সন্দেহ নাই। সেই একশত দিনের সর্বাঙ্গে অর্থনীতির ক্ষত। চন্দ্রযানের বিভায় সেই ক্ষত চাপা পড়িত। ঘোষিত হইত, এই মহাজাগতিক সাফল্যের পার্শ্বে সকল ব্যর্থতাই নিতান্ত ম্লান হইয়া যায়। ভক্তরা ভগবানের নামে জয়ধ্বনি করিয়া বলিতেন, ‘মুমকিন হ্যায়’। কে বলিতে পারে, হয়তো সেই মুহূর্তটিকে দুই হাতে ধরিবেন বলিয়াই গভীর রাত্রিতেও নির্নিমেষ টেলিভিশন ক্যামেরার সম্মুখে জাগিয়া ছিলেন তিনি। শেষ দুই কিলোমিটার এই সুযোগটি কাড়িয়া লইল। তিনি আশাহত হন নাই, হলফ করিয়া বলা মুশকিল। কিন্তু, তাঁহার হতাশা ক্যামেরা দেখিতে পায় নাই। তিনি দেখান নাই বলিয়াই। ক্যামেরা দেখিল, ইসরো-র প্রধানকে তিনি বুকে টানিয়া লইয়াছেন। পিঠ চাপড়াইয়া সাহস দিতেছেন। ইসরো প্রধানের চোখে জল ছিল কি না, সেই তর্ক অতএব অবান্তর— এক ‘ব্যর্থ’, ‘পরাভূত’ রাজকর্মচারীকে স্বয়ং রাজা সান্ত্বনা দিতেছেন, এই ব্যঞ্জনাতেই মুহূর্তটির সার্থকতা।

এবং, ‘মোদী ম্যাজিক’ যদি কোথাও থাকে, তবে তাহা এই দৃশ্যনির্মাণের দক্ষতায়। যে কোনও মুহূর্তকে শেষ অবধি অধিকার করিয়া লওয়ার, নিজস্ব মুহূর্তে পরিণত করিবার প্রতিভায়। নিজের সহিত জাতীয়তাবাদের, এবং জাতীয়তাবাদের সহিত প্রশ্নহীন আনুগত্যের ঐকান্তিক সম্পর্ক তিনি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা করিয়া ফেলিয়াছেন। ইসরো-র ঘটনাক্রমকেও সেই সূত্রে বাঁধিলেন তিনি। জনসভায় বলিলেন, গোটা দেশে এখন ইসরো-মানসিকতার ঢেউ, এক্ষণে কোনও নেতিবাচক মনোভাব কেহ বরদাস্ত করিবে না। অর্থাৎ, ইসরো-র ব্যর্থতা লইয়াও প্রশ্ন চলিবে না, অর্থনীতির ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়াও নহে, এনআরসি-র বকলমে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে ‘অ-ভারতীয়’ করিয়া দেওয়া লইয়াও নহে। চন্দ্রযানের সফল অবতরণ তাঁহাকে যে সুযোগ করিয়া দিত, তাহার ব্যর্থতাকেও নরেন্দ্র মোদী সেই সুযোগেই পাল্টাইয়া লইলেন। দক্ষতাটি ঈর্ষণীয়। অবশ্য, শুধু ইসরো নহে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিটি সাফল্যও এই একই ভাবে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জয়ে পরিণত হইয়াছে। যেমন, বালাকোট হামলার পিছনে নিজের ভূমিকা ব্যাখ্যা করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন— বায়ুসেনার কর্তাদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়াই তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, আকাশে মেঘ থাকায় সুবিধা মিলিবে, পাকিস্তানি রেডারে এই অভিযান ধরা পড়িবে না। অস্যার্থ, তিনি ছিলেন বলিয়াই সম্ভব হইয়াছিল। পরিশীলিত রুচির কোনও নাগরিকের নিকট প্রধানমন্ত্রীর এহেন আচরণ হয়তো দৃষ্টিকটু ঠেকিতে পারে। হয়তো মনে হইতে পারে, ইহা নিতান্ত উপরচালাকি, সেলসম্যানের কথার খেলা। প্রধানমন্ত্রীর পদের গুরুত্বের সহিত বেমানান। কিন্তু, অনুমান করা চলে, সে কথা ভাবিবার মতো লোক নিতান্তই মুষ্টিমেয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাহা জানেন। অর্থনীতির ডুবন্ত জাহাজে বসিয়াও যে ভারতবাসীরা বিশ্বাস করিতেছেন একমাত্র মোদীই রক্ষা করিতে পারিবেন, তাঁহারা এই নির্মিত দৃশ্যগুলিই দেখিতে চাহেন, প্রধানমন্ত্রী জানেন। রূপকথা নির্মিতই হইয়া থাকে। তাঁহার নির্মাণ-প্রতিভা যে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতিকেও রূপকথার অঙ্গ করিয়া লইতে পারে, নরেন্দ্র মোদী বারংবার তাহা প্রমাণ করিতেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chandrayaan 2 Moon Mission Narendra Modi K Sivan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE