লোকসভায় নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
প্রথম বার সংসদে পা রাখিবার পূর্বে তাঁহার সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত দেখিয়া অনেকেই ভাবিয়াছিলেন, ২০০২ সালের রাজধর্ম পালনে সমূহ ব্যর্থতাকে তিনি হয়তো পিছনে ফেলিয়া আসিয়াছেন। গণতন্ত্রের পাঠ বুঝি অতঃপর শিখিয়া লইবেন। পরবর্তী পাঁচ বৎসর বুঝাইয়া দিয়াছে, আশাটি নিতান্ত অমূলক ছিল। কিন্তু, যাঁহারা বিশ্বাস করিয়াছিলেন, তাঁহাদের দোষ দেওয়া চলে কি? শিক্ষা নাকি অর্জিত হয় ‘প্রণিপাতেন, পরিপ্রশ্নেন, সেবয়া’— প্রণিপাতেই শিক্ষার সূচনা। ষোড়শ লোকসভায় বিদায়ী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জানাইলেন, পাঁচ বৎসরে তিনি ‘অনেক কিছু শিখিয়াছেন’। নিন্দুকে বলিবে, এই দফায় বেশ কিছু জিনিসই তাঁহার শেখা হইল না। যেমন, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার। নিন্দা উড়াইয়া দিবার নহে। অন্তত বিদায়ী ভাষণটিকেও প্রধানমন্ত্রী যদি সৌজন্যের তারে বাঁধিতে পারিতেন, তবে পাঁচ বৎসরের অতীত না মুছিলেও, তিনি সংসদকক্ষকে কী ভাবে মেঠো রাজনীতির পরিসরের ন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন তাহা না ভুলিলেও, ভারতীয় গণতন্ত্রের শীর্ষ পরিসরে তাঁহার পৌনঃপুনিক অসৌজন্য বিস্মৃত না হইলেও, হয়তো-বা একটি প্রলেপ পড়িত। হয়তো বোঝা যাইত, রাজনীতির তাগিদ যতই তীব্র হউক, গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষার কথাটি প্রধানমন্ত্রী বিস্মৃত হন নাই। আশা দুর্মর, তাই হয়তো এই বার্তাটির আশায় তাকাইয়া ছিল সমগ্র ভারতীয় গণতন্ত্র। বিশেষত এমন এক সময়ে যখন অশিষ্টতাই রাজনীতির জাতীয় ভাষা হইয়া উঠিয়াছে, অসৌজন্যই রাজনীতির মুদ্রাদোষে পরিণত হইয়াছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছ হইতে একটি বিদায়ী বার্তা দরকার ছিল। তাহা ঘটিল না। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে এবং নিজের ভাষণটিকেও আবারও সেই ক্ষুদ্রতাতেই আবদ্ধ রাখিলেন। গণতন্ত্রে লাভক্ষতির হিসাব ছাড়াও একটি সৌজন্যের অঙ্ক কষিতে শিখিতে হয়। পাঁচ বৎসরে প্রধানমন্ত্রী তাহা এক বিন্দুও শিখিয়া উঠিতে পারেন নাই।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি সংবাদমাধ্যমকে এড়াইয়া চলিতেন। আশা ছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী হইবার পর তিনি গণতন্ত্রের স্বার্থেই সংবাদমাধ্যমকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিবেন। প্রশ্ন শুনিবেন, সমালোচনাও, এবং নিজের উত্তর জানাইবেন। আশা পূরণ হয় নাই। ইতিহাসে লেখা থাকিল, এই প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বৎসরে একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেন নাই। কথা অনেক বলিয়াছেন হয়তো প্রয়োজনের অধিক বলিয়াছেন, কিন্তু সেই কথা সমাজমাধ্যমে, নিজস্ব অ্যাপে, ‘মন কি বাত’-এ, বিজ্ঞাপনে। এমন পরিসরে, যেখানে অপর পক্ষের কথা বলিবার অবকাশ নাই। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি তিনি শিখিলেন না। দৃশ্যত, শিখিতে চাহিলেনও না। রাজধর্ম পালনে যত বিচ্যুতি ঘটিল, তাহার দায় লইতে শিখিলেন না। এমনকি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটনাগুলির উল্লেখ করিতেই ভুলিলেন তিনি।
এই পাঁচ বৎসরে গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরাজয় দেখা গেল বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হইয়া নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসিলেন বটে, প্রধানমন্ত্রী হইয়া উঠিতে পারিলেন না। ঘটনাটি দুঃখের, কারণ রাজনৈতিক ভাবে কেহ ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর সমানুবর্তী হউন বা না হউন, প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেকের নেতা। পদটির নিকট যে আচরণ, যে সমদর্শিতা প্রত্যাশিত, প্রধানমন্ত্রী যদি নিজেকে সেই স্তরে উন্নীত না করিতে পারেন, এক অর্থে তাহা দেশেরই ব্যর্থতা। ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর দৃশ্যত এই গুণগুলি ছিল না। তিনি যে শিখিতেও পারিলেন না, তাহা সমধিক দুঃখের। প্রবল সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও কী ভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করিতে হয়, তাহা জওহরলাল নেহরুর নিকট শিখিতে পারিতেন। শিষ্টতার পাঠ লইতে পারিতেন মনমোহন সিংহের নিকট। হয়তো, প্রথম দিন মোদী যে প্রণিপাত করিয়াছিলেন, তাহাতে শুধু বাহ্যিক রূপটিই ছিল। অন্তরের সমর্পণ ছিল না। হয়তো সেই কারণেই তিনি শিখিলেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy