Advertisement
E-Paper

স্থিতাবস্থার বিদেশনীতি বদলাতে চান মোদী, কিন্তু আমরা তৈরি তো?

নেহরু কোনও দিন ভাবেননি যে চিন আক্রমণ করতে পারে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালনেহরু কোনও দিন ভাবেননি যে চিন আক্রমণ করতে পারে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৭ ০০:০৬
ডোকালামে চিন-ভারত দ্বৈরথ চরমে।—ফাইল চিত্র।

ডোকালামে চিন-ভারত দ্বৈরথ চরমে।—ফাইল চিত্র।

’৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধে পরাজয়ের পর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন পদত্যাগ করেন। নেহরুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইট মে বি আ স্মল কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ওয়ার এফোর্ট।’ পদত্যাগপত্রে তিনি আরও লেখেন, ‘যে ভালবাসা ও আস্থা আমার প্রতি আপনি দেখিয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আজকের এই উত্তাল পরিস্থিতি যখন ঠান্ডা হয়ে যাবে, তখন যদি প্রমাণ হয় এই আস্থা আমার প্রতি রাখা উচিত হয়নি এবং আমার প্রতি বিশ্বাসের অমর্যাদা হয়েছে তবে আমি তার জন্য যে কোনও পরিণতি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করব।’ ১৯৭৪-এর অক্টোবরে কৃষ্ণ মেননের মৃত্যু হয়। তাই সরকার ছেড়ে চলে যাওয়া ইস্তক পরবর্তী ১২ বছরে কখনওই মেননের জীবনে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যাতে তাঁকে অনুতপ্ত হতে হয়।

বরং কৃষ্ণ মেনন চিন সম্পর্কে যা বলেছিলেন পরবর্তী কালে তাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। প্রয়াত ইন্দিরা গাঁধী বরং চিনের আক্রমণ সম্পর্কে পরবর্তী কালে বলেন, ‘হ্যাড দ্য সলিউশন হুইচ হি (মেনন) হ্যাড প্রোপোসড অন বিহাফ অফ ইন্ডিয়া ইন দ্য ফিফটিজ ফর দ্য ইন্ডিয়া-চায়না সিচুয়েশন বিন অ্যাক্সেপ্টেড, আ গ্রেট ডিল অফ হার্ডশিপ, সাফারিং অ্যান্ড ওয়েস্ট কুড হ্যাভ বিন অ্যাভয়েডেড। ফর মেনি অব দ্য প্রবলেমস অফ দ্য ডে, হি হ্যাড, অ্যাজ আই সেইড আ সলিউশন অ্যান্ড ইফ ইট ওয়াজ নট অ্যাক্সেপ্টেড, দ্যাট ওয়াজ নট হিজ ফল্ট।’

১৯৬২ সালে মুখোমুখি ভারত ও চিনা সেনা।—ফাইল চিত্র।

আজ ভারত ও চিনের সাম্প্রতিক যুদ্ধজিগির ও উত্তেজনা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে নেহরু এবং কৃষ্ণ মেননের সেই সময়কার মতামতের আদানপ্রদান বিশেষ ভাবে জানা জরুরি। সত্যি কথা বলতে কি, নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিদেশনীতি নিয়ে মাথা ঘামালেও কখনওই জাতীয় নিরাপত্তা নীতি নিয়ে মাথা ঘামাননি। দ্বিতীয়ত, ’৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর নেহরু চাননি, ভারতের প্রতিরক্ষা ও সেনাবাহিনীতে ব্রিটিশ অফিসারেরা থাকুন। সাম্রাজ্যবাদের অবসানের প্রতীক হিসেবে দ্রুত ওই সাহেবদের দেশছাড়া করা হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, ১৯২০ সাল থেকে ব্রিটিশরা বেছে বেছে ভারতীয় সেনা অফিসারদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তার মানে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় সেনা অফিসারদের নিজস্ব কোর-অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র ২৭ বছরের।

নেহরু সেনাবাহিনীকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিতেও রাজি ছিলেন না। তিনি ভাবতেন, ভারত যেন পাকিস্তান না হয়ে যায়। তাই মন্ত্রিসভার রাজনীতি ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক কমিটিতে সেনাপ্রধানদের কখনওই রাখা হত না। নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়াটির রাজনেতাদের হাতেই থাকত। সেনাবাহিনী থাকবে আদেশ পালনের জন্য। যেটি মূলত অপারেশনাল। অনেকে মনে করেন, এটা নেহরুর ভুল ছিল। বস্তুত, চিনের আক্রমণের পর বিদেশনীতির পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা নীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে ভারত।

১৯৯৯ সালে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটি যখন গঠিত হয় তখনও অনেকে বলেছিলেন, এটি আমেরিকান ধারণা। আমাদের দেশে এটার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। এতে সমন্বয়ের চেয়ে বিবাদ বাড়বে বেশি। এই পদটি বিদেশ মন্ত্রক, গোয়েন্দা বাহিনী ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের (পিএমও) ভিতরে এক প্রাতিষ্ঠানিক সেতু হিসেবে বিকশিত হয়। পরবর্তী কালে তাই কংগ্রেসও এই প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনটিকে অবলুপ্ত করেনি।

জওহরলাল নেহরু এবং ভি কে কৃষ্ণ মেনন।—ফাইল চিত্র।

নেহরু জমানা থেকে আজ পর্যন্ত যে ভাবে বিদেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতি চলেছে সে সম্পর্কে বহু বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি হল স্থিতাবস্থা বজায় রাখার রীতি। ভারত কোনও রকম সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাস করে না। বুদ্ধ এবং গাঁধীর দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। কিন্তু আজ যখন চিন থেকে রাশিয়া, সকলেই গোপনে ও আধা-প্রকাশ্যে নিজেদের সার্বভৌম ভূখণ্ড প্রসারিত করার চেষ্টা করছে, পরিকাঠামোগত উন্নয়নের নামে সীমান্তে প্রভাব বাড়াচ্ছে, তখনও কি ভারতের পুরনো কাঠামোতে পরিবর্তন আনা বিশেষ জরুরি নয়?

১৫ অগস্ট নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এই ‘চলতা হ্যায়’ মানসিকতায় পরিবর্তন আনা জরুরি। চাই ‘বদলনা হ্যায়’ এই স্লোগান। খুবই ভাল কথা। নরেন্দ্র মোদীকে যতটা চিনি তাতে ওঁর মধ্যে যে বদলানোর ইচ্ছা নেই, এমনও নয়। কিন্তু এত বছর ধরে যে আমলাতন্ত্র, যে প্রতিষ্ঠানে কোনও পরিবর্তন আসেনি, সেখানে হঠাৎ কি কোনও পরিবর্তন সম্ভব?

কৃষ্ণ মেনন বলেছেন, নেহরুর ভাবনা খুব স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু তাঁর সমস্যা ছিল, তিনি ক্যাবিনেট বৈঠকেও কোনও আলোচনাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। নেহরু কোনও দিন ভাবেননি যে চিন আক্রমণ করতে পারে। বরং নেহরুর প্রথম গোয়েন্দা প্রধান ভোলানাথ মল্লিক লিখেছেন যে, এমন ঠান্ডায় বরফ ডিঙিয়ে চিনা সেনার আসা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন নেহরু।

মেনন তা মনে করেননি। তিনি বার বার সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন। আবার এটাও বলেছিলেন, চিন আক্রমণ করলে ভারত তা রোখার মতো ক্ষমতায় নেই। তাই যে কোনও মূল্যে যুদ্ধকে আটকে আলোচনার রাস্তাতেই যাওয়া উচিত।

মোদী স্থিতাবস্থার বিদেশনীতি বদলাতে চান। খুব ভাল কথা। কিন্তু আজও কি আমরা তৈরি?

India-China India China Doklam Standoff Narendra Modi PM নরেন্দ্র মোদী ভারত চিন Foreign Policy শাহি সমাচার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy