Advertisement
E-Paper

হারিয়ে গেছে আত্মসম্মানবোধও

যূথশক্তির উন্মাদনায় যাঁরা তাণ্ডবে মেতেছিলেন, তাঁদের এই বোধটুকুও নেই যে, এই আচরণ তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সম্মান, এবং তাঁদের নিজেদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ এমন কুকীর্তি করল কেন, সেই অনিবার্য প্রশ্নের জবাবে টিভি চ্যানেলের সান্ধ্য আসরে উপস্থিত এক ছাত্র সে দিন বললেন, ‘মানছি, এই আচরণ ঠিক হয়নি, কিন্তু আসলে অনেক দিন ধরে অনেক ক্ষোভ জমা হচ্ছিল, একটা বয়েলিং পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছিল।’

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:২২

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ এমন কুকীর্তি করল কেন, সেই অনিবার্য প্রশ্নের জবাবে টিভি চ্যানেলের সান্ধ্য আসরে উপস্থিত এক ছাত্র সে দিন বললেন, ‘মানছি, এই আচরণ ঠিক হয়নি, কিন্তু আসলে অনেক দিন ধরে অনেক ক্ষোভ জমা হচ্ছিল, একটা বয়েলিং পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছিল।’ এক এক জিনিস এক এক তাপমাত্রায় ফোটে, তেল ফোটার অনেক আগেই জল টগবগ করতে শুরু করে। সব মানুষকেও ফুটিয়ে তোলার তাপমাত্রা এক নয়। কেউ অল্প আঁচে ফুটন্ত, কেউ ভারতীয় সংসদেও বরফশীতল। আবার, কালক্রমে স্বভাব পালটায়। ইদানীং, অন্তত আমাদের এ তল্লাটে মানুষের স্ফুটন-বিন্দু যে আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে, সেটা প্রতি দিন চার পাশে তাকালেই টের পাই। আর, কম বয়েসে অল্পেই মাথা গরম হয়ে যেতে পারে, এমন একটা ধারণাও বেশ প্রচলিত, যদিও রাজনীতির দৈনন্দিন তরজায় প্রবীণ ‘বিদ্বজ্জন’দের ইদানীং যে রকম সতত ধূমায়মান দেখি, তাতে ওই পুরনো ধারণাটার আর বিশেষ মানে আছে বলে মনে হয় না। তা, হতেই পারে যে, ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্নিহিত আগ্নেয়গিরি অনেক দিন ধরে ফুটছিল, এ বার তার বিস্ফোরণ ঘটল। বিস্ফোরণ অবশ্য আগেও ঘটেছে, প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের জ্বলন্ত ক্রোধের নানান দৃশ্য অধুনা প্রায়শই দেখা গেছে, কিন্তু তাতে হয়তো সব রাগের জ্বালা নির্গত হয়নি। না হতেই পারে। এক আগ্নেয়গিরির একাধিক বার জেগে ওঠা, এক এলাকায় বার বার ভূমিকম্প, এ-রকম তো কতই হয়।

ছাত্রছাত্রীদের ক্রোধের কিছুমাত্র কারণ নেই, সে কথা বললে মাননীয় উপাচার্য খুশি হতে পারেন, কিন্তু সত্যের অপলাপ হবে। পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষার দুনিয়ায় বহু দিন ধরেই বহু অন্যায় জমে উঠেছে, কিন্তু ইদানীং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যা চলছে, তা দেখে প্রয়াত অনিল বিশ্বাসও সম্ভবত ভাবতেন: ভুল হয়ে গেছে বিলকুল। এই অবিরত শোরগোলের বাজারে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে নেওয়া ভাল। প্রেসিডেন্সির অধঃপতন আজকের কথা নয়। এবং মনে রাখা দরকার, অশান্ত রাজনীতিকে সেই অধঃপাতের প্রধান কারণ বললে ভুল হবে। ঐতিহাসিক ভুল। ষাট-সত্তরের উত্তাল পর্বের পরেও এই প্রতিষ্ঠানের গৌরব অন্তর্হিত হয়নি। সেই টালমাটাল বিদ্যাচর্চার ক্ষতি করেছে, কিন্তু বিদ্যায়তনের প্রাণশক্তি কেড়ে নিতে পারেনি। প্রাণহরণের পালা শুরু হয় আশির দশকে, বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে স্থিত হওয়ার পরে। অশান্তি যা পারেনি, শান্তিপর্বে তা সম্ভব হল— প্রেসিডেন্সিতে আনুগত্যের শাসন কায়েম হল। উৎকর্ষকে বিনাশ করতে চাইলে আনুগত্যের চেয়ে কড়া ওষুধ হয় না। আলিমুদ্দিনের কর্তারা সেই ঔষধি প্রয়োগে অ-তুলনীয় ছিলেন। তাঁদের দাপটে প্রেসিডেন্সির উৎকর্ষ বিদায় নিয়েছিল। অনেক কাল পরে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তার নবকলেবরে সেই হৃতসম্পদ পুনরুদ্ধারের একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। জানি না, হয়তো আজও সে বিষয়ে সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়নি। কিন্তু লক্ষণ খুবই উদ্বেগজনক। বিশেষত, নতুন প্রতিষ্ঠান ভাল করে সচল হয়ে ওঠার আগেই একের পর এক সুশিক্ষকের ছেড়ে যাওয়ার খবর শুনে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিরাট আশাবাদী হওয়া একটু কঠিন বলেই মনে হয়। ছাত্রছাত্রীরা এই পরিস্থিতিতে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে তাঁদের দোষ দেওয়া চলে না। উদ্বেগ থেকে ক্ষোভের জন্মও স্বাভাবিক।

উপাচার্য এবং তাঁর সহযোগীরা এই উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রশমনের যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন কি? ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গত ও স্বাভাবিক ক্ষোভ বা উদ্বেগগুলির মোকাবিলায় যথেষ্ট আন্তরিক ভাবে তৎপর হয়েছেন কি? অন্তত তাঁদের অভিযোগ শোনার ও তার প্রতিকারের উদ্যোগ নিয়েছেন কি? ‘ভেতরের খবর’ জানি না, আজকাল আর তার ওপর বিশেষ আস্থাও নেই, তার চেয়ে বাইরের খবরই মন দিয়ে দেখা শ্রেয় বলে মনে হয়। তো, প্রেসিডেন্সি থেকে একাধিক প্রবীণ এবং কৃতী শিক্ষকের বিদায় নেওয়ার ঘটনাগুলিতে উপাচার্যের যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি, তাতে খুব ভরসা পাইনি। এক জন ভাল শিক্ষক চলে গেলে ‘আমাদের এখানে ভাল শিক্ষক আরও আছেন’ বলাটা বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় না, উৎকর্ষ সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তিত হওয়ারও পরিচয় দেয় না। মাননীয় উপাচার্য হয়তো বলবেন, তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুবই চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু এ-যাবৎ সেটা তিনি বিশেষ বুঝতে দেননি। উল্টো দিকে, তাঁর আচরণে যে ব্যাধির লক্ষণ দেখে শঙ্কিত বোধ করেছি, সেটি ওই পুরনো আনুগত্যের ব্যাধি। তিনি বলতেই পারেন, এই শঙ্কা অমূলক, তিনি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা এবং নিরপেক্ষ। কিন্তু আবারও বলব, রাজ্যের শাসকদের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য দেখে সেটা বোঝা দুষ্কর। বিশেষ করে যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত প্রতিষ্ঠানে নিজের দাপট প্রদর্শন করে বেড়ান এবং শিক্ষামন্ত্রী কথায় কথায় শিক্ষকদের উদ্দেশে হাঁক পাড়েন, ‘মাইনে দিচ্ছি, কথা শুনবে না মানে?’, সেখানে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল থেকে নিজেকে এবং নিজের প্রতিষ্ঠানকে শতহস্ত দূরে রাখতে হয়। এই কাণ্ডজ্ঞান যদি মাননীয় উপাচার্যের ভাণ্ডারে থাকে, তবে সেটা তিনি এমন যত্নসহকারে লুকিয়ে রাখছেন কেন, জানি না।

প্রেসিডেন্সির পরিচালকদের আচরণে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ অহেতুক বলে উড়িয়ে দেওয়া তাই কঠিন। ‘বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী আমার পক্ষে আছে’, এটাও কোনও কাজের কথা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভোটের ময়দান নয়, আর প্রতিবাদী বা বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা চিরকালই কম হয়।

কিন্তু ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ জানাব কী ভাবে? যে কোনও আন্দোলনের ভাষা ও ভঙ্গি সেই আন্দোলনের খুব বড় অঙ্গ। একটি অগ্রণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এ বিষয়ে সচেতন থাকবেন, এটা তাঁদের কাছে আশা করা অন্যায় নয়। তাঁরা সফল শিক্ষার্থী, সচরাচর সুস্থ, সচ্ছল, সুবিধাভোগী বর্গের সন্তান, উচ্চশিক্ষার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে কৃতী হবেন বা উচ্চতর শিক্ষার দুনিয়ায় প্রবেশ করবেন, অনেকে দেশের গণ্ডি পার হয়ে বিশ্ববাসী হবেন। কী ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা করা এবং সেই চিন্তা অনুসারে আন্দোলন তৈরি করা এই তরুণতরুণীদের একটা গুরুতর নৈতিক দায়িত্ব। এই নৈতিকতা পুরনো তপোবনসুলভ আদর্শের ব্যাপার নয়, ‘ছাত্রাণাম্ অধ্যয়নং তপঃ’ গোছের ছেঁদো কথা দিয়ে আজ আর এক পা-ও এগোনো যাবে না। কিন্তু নতুন নৈতিকতা নির্মাণের দায় না নিলে প্রতিবাদের কোনও নীতিগত জোর থাকে না, সেটা যূথশক্তির অশালীন আস্ফালনে পরিণত হয়। এ দেশের অধিকাংশ ‘ছাত্র আন্দোলন’-এ এখন সেটাই ঘটে থাকে।

প্রেসিডেন্সিতেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটল। এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ একটা কুৎসিত আকার ধারণ করল। শিক্ষামন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের যে অভিযোগই থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের প্রতি দুর্ব্যবহারের কিছুমাত্র যুক্তি ছিল না। আবার সেই সূত্রে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ধুয়ো তুলে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করা, সেই দাবি না মানলে ‘ঘেরাও চলবে’ বলে তাঁর ঘর দখল করে বসে থাকা, সেখানে উৎকট উচ্ছৃঙ্খলতার তাণ্ডব— গোটাটাই নির্ভেজাল অসভ্যতার প্রদর্শনী। এ দৃশ্য দেখে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হিসেবে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগ বোধহয় এইখানে যে, বেলাগাম যূথশক্তির উন্মাদনায় যাঁরা সেই তাণ্ডবে মেতেছিলেন, তাঁদের এই বোধটুকুও ছিল না বা আজও নেই যে, এই আচরণ তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সম্মান, এবং তাঁদের নিজেদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। অনুমান করা যায়, রাজনৈতিক দল ছাত্রদের ক্ষোভের সুযোগ নিতে চেয়েছে, যেমন সর্বত্রই চায়। কিন্তু দলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ‘কৃতী ছাত্রছাত্রী’রা তাঁদের ব্যক্তিগত দায় এড়াতে পারেন না।

এই পশ্চিমবঙ্গের সমাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আজকাল সব সময় মনে হয়, নিজেকে নিয়ে তার কোনও সৎ অহঙ্কার নেই। আত্মসম্মানবোধ নেই। প্রেসিডেন্সির প্রতিবাদীরা প্রমাণ করলেন, তাঁরা এই সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। সে ছবি উজ্জ্বল নয়।

new generation students new generation self respect presidency university anuradha lohia presidency sfi chaos sfi presidency chaos anirban chattopadhyay abp post editorial abp latest post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy