হাওড়া পুরসভা। —ফাইল চিত্র।
বিনা নোটিসে মাথার উপর উড়ালপুল ভাঙিয়া পড়িবার ঘটনায় ইতিমধ্যেই কলিকাতা অভ্যস্ত। এই বার হাওড়া দেখিল, কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াই সদ্য-নির্মিত পাঁচতলা বাড়ি ভাঙিয়া পড়িতেছে। না, ‘শেষের সেই দিন’ আসিয়া উপস্থিত হয় নাই। বরং, যেমন তেমন করিয়া পুকুর বুজাইয়া বহুতল হাঁকাইলে যাহা হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তেমনটাই সম্প্রতি ঘটিয়াছে সালকিয়ায়। মাটিতে বসিয়া গিয়াছে বহুতলটির নীচের তলা। হেলিয়া পড়িয়াছে পার্শ্ববর্তী গৃহের উপর। এবং বিস্তর আতঙ্ক ছড়াইয়াছে অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে। হতাহত যে কেহ হয় নাই, তাহা নিতান্তই ভাগ্যক্রমে।
বহুতল ভাঙিয়া পড়িবার কারণ হিসাবে নিকৃষ্ট মালমশলা ব্যবহারের প্রসঙ্গ প্রায়শই উঠে। কিন্তু গলদ এই ক্ষেত্রে শুধু উপাদানে নহে, সমগ্র নির্মাণকার্যটিই ছিল বেআইনি। প্রথমত, নিয়মকে তুড়ি মারিয়া অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ রাস্তার উপর তাহা গড়িয়া উঠিয়াছে। স্থানীয়রাও প্রশ্ন তুলিয়াছেন— যেখানে দোতলা বাড়ির নকশা পুরসভা হইতে অনুমোদন করাইতে গেলে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হন, সেখানে পাঁচতলা বাড়ি উঠে কী উপায়ে? উপায়টি সম্ভবত সকলেরই জানা— কথিত আছে, পুরসভার রাজত্বে কাঞ্চনরঙ্গে সব অ-সম্ভবই সম্ভব হইতে পারে। অনুমান, এই ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়াছে। সেই কারণেই আদালতের স্থগিতাদেশ অগ্রাহ্য করিবার সাহস হইয়াছে। তদুপরি, বাড়িটি জলাভূমি ভরাট করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল। জলাভূমি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরিয়া সচেতন করিতেছেন পরিবেশবিদরা। জলাভূমি যথেচ্ছ ভরাট করিবার প্রবণতা রুখিতে কড়া আইনও আছে। এমনকি নিয়ম আছে, সংরক্ষণের প্রয়োজনে সরকার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জলাভূমি অধিগ্রহণও করিতে পারে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও পুকুর চুরি কমিতেছে কই? পুকুর বুজাইয়া বহুতল তুলিবার অগণিত উদাহরণের মধ্যে সালকিয়ার ঘটনাটি এক ক্ষুদ্র কণামাত্র। কলিকাতা তো বটেই, জেলার জলাভূমিও প্রোমোটারের গ্রাসে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর। ইট-কংক্রিটের জঙ্গলে ক্রমশ চাপা পড়িতেছে বাস্তুতন্ত্রের এই আবশ্যক অংশটি।
কিন্তু তাহা লইয়া তেমন হইচই নাই। নিঃশব্দে, প্রায় সকলের অলক্ষ্যে হারাইয়া যাইতেছে পূর্ব কলিকাতার জলাভূমি অঞ্চল। পরিবেশকর্মীরা দেখাইতেছেন, এই সংরক্ষিত অঞ্চলে প্রতি বৎসর প্রায় পঞ্চাশটি জলাভূমি অবৈধ ভাবে ভরাট হইতেছে। পুলিশ ২০০৯ সাল হইতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেআইনি নির্মাণ এবং জলাভূমির চরিত্র পরিবর্তন সংক্রান্ত ৩৫৩টি মামলা করিয়াছে। কিন্তু পূর্ব কলিকাতা জলাভূমি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সেই অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধ করিবার এবং জলাভূমিকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিবার চেষ্টা হইয়াছে কি না, তাহার কোনও উল্লেখ নাই। ধরিয়া লওয়া যায়, পুলিশ-প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই আইন ভাঙা হইতেছে। যিনি আইন ভাঙিতেছেন, তিনি অপরাধী। পরিবেশ নষ্ট করিবার দায়ে তাহার কঠোর শাস্তি প্রাপ্য। শাস্তি প্রাপ্য তাঁহাদেরও, যাঁহাদের উপর নজরদারির দায়িত্বটি ছিল। যেমন, সালকিয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং সংশ্লিষ্ট থানার আধিকারিকদের। পরিবেশ ধ্বংস হইতেছে দেখিয়াও তাঁহারা আইন প্রয়োগ করেন নাই এবং চুপ থাকিয়া সেই ধ্বংসকার্যে পরোক্ষ সম্মতি দিয়াছেন। ইঁহারা শাস্তি না পাইলে পরিবেশ বাঁচাইবার আশা নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy