Advertisement
E-Paper

শীতে কেমন থাকেন, বাড়িতে থাকা মেয়েরা?

এই শীতে তাঁরা কেমন আছেন? বাড়িতে থাকা মেয়েরা? চাকরি করতে পারা মেয়েদের থেকে তাঁরা একটু আলাদা তো বটেই, কারণ তাঁরা উপার্জন করেন না।

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৫

এই মরশুমে রেকর্ড শীত পড়েছে। আমাদের সবার মুখস্থ শীতের ব্যাটিং স্কোর। গত সাত বছরে এই প্রথম টানা দশ দিন ধরে তাপমাত্রা এগারো ডিগ্রির সেলসিয়াসের নীচে ইত্যাদি। খবরের কাগজে থাকছে বিশেষ শীতের পাতা, শীত নিয়ে হচ্ছে টিভির অনুষ্ঠান, শীতে কী রাঁধবেন, কী খাবেন, কেমন করে সাজবেন, এ-সব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কিছু দুঃখী ধরনের অনুষ্ঠানও হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে, শীতেরা আগে কেমন কমলালেবু-রঙের ছিল, এখন কেমন এলইডি-ঝলমল।

তবে শীতের পক্ষপাত আমরা দেখেও দেখি না। ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদের কথা বলছি না। ও-ধরনের ব্যাপারে সত্যিকারের মনঃকষ্ট যাতে আক্রমণ না করে— সেই টীকা আমাদের জন্ম ইস্তক নেওয়া আছে। আমরা যখন লং-কোট পরব, না কাশ্মীরি পোশাক— তাই নিয়ে প্রবল চিন্তিত, আমার বাড়ির ঢিল-ছোড়া দূরত্বে কার গায়ে গরম জামা নেই— এটা আমাদের আদৌ ভাবার বিষয় নয়। একান্ত বিবেক-দংশন হলে বাড়ির কাজের মাসির বাচ্চাকে পুরনো সোয়েটার বা শাল দিয়ে দিই, রথ দেখা ও কলা বেচার আনন্দ দুই-ই লাভ হয়। সঙ্গে ‘আহা রে কী কষ্ট! জানিস তো ওই মাসিমা ‘ওদের’ জন্য খুব করেন’ ধরনের মন্তব্য ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্রি।

তবে আরও কেউ কেউ আছেন, যাঁদের জন্য এই দীর্ঘশ্বাসটুকুও খরচা করা হয় না। না, আমি ফুটপাতে বসবাসকারী ভিখারি বা পাগলের কথা বলছি না। এমনকী সিরিয়া লেবাননের শরণার্থী শিবির বা রোহিঙ্গাদের কথাও বলছি না। বলছি আমাদের পরিবারের খুব সাদামাটা একটা অংশের কথা, এতটাই সাদামাটা যে তাঁদের কথা আমাদের আলাদা করে মনেই থাকে না। যখন মনে পড়ে, তখন ‘হোম-মেকার’, ‘বাড়ির ক্যাপ্টেন’ ইত্যাদি নাম দিয়ে তাঁদের বঞ্চনায় একটু প্রলেপ দিয়ে দিই।

এই শীতে তাঁরা কেমন আছেন? বাড়িতে থাকা মেয়েরা? চাকরি করতে পারা মেয়েদের থেকে তাঁরা একটু আলাদা তো বটেই, কারণ তাঁরা উপার্জন করেন না। মাত্র ১৩.৪% মহিলা আমাদের দেশে এখনও সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, সারা পৃথিবীতে ৪৮%। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলিয়ে উপার্জনক্ষম মহিলাদের সংখ্যা ৪২%। তবে তাঁদের মধ্যেও নিজের ইচ্ছেমত নিজের রোজগার ব্যবহার করতে পারেন, সেই গোত্রের অন্তর্গত মাত্র ২৪%। চাকরি ও বাড়ির কাজকর্ম দুই-ই সামলাতে হয়, এমন মহিলাদের অংশও (৩৯%) কম নয়। তবু তাঁদের একটুখানি সরিয়ে রাখার কারণ, উপরের সব তথ্যের পরেও, তাঁদের কিছুটা হলেও ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছে। উপার্জন-করা মহিলাদের সংখ্যাটা কম হলেও— তাঁরা স্বাধীন উপার্জন করেন, সেই উপলক্ষে বাড়ি থেকে বাইরে বেরবার স্বাধীনতা পান, শীতকালটা বাড়ির বাইরে ঠিক কী রকম তা জানার জন্য বরের অফিসের বা হাউসিং-এর পিকনিক, বা সপ্তাহে এক বার বাপের বাড়ি বা সপরিবার শপিং মল পরিদর্শনের উপলক্ষের খোঁজ করতে হয় না। আর এই মহিলাদের চাকরিরতা হয়ে বাড়ির কাজ করতে হলেও, তা পার্টটাইম— কিছুক্ষণের জন্যও ছুটি আছে। বাড়িতে থাকা মহিলাদের কিন্তু তা নেই।

কেমন কাটে বাড়ির মহিলাদের শীত? আসুন সকাল থেকে শুরু করি। সহায়িকা কাজের মাসিওয়ালা বাড়ির সংখ্যা ২২%, তাই বাড়ির কাজ মূলত বাড়ির মহিলাদের করতে হয়। শীত বলতে লেপের তলা থেকে হাত বাড়িয়ে গরম চা বা কফির কাপ নেওয়ার যে-ছবি সব শীতসংক্রান্ত লেখায় প্রায় বাধ্যতামূলক— তা ক’জন মহিলা উপভোগ করতে পারেন? এগুলো নিয়ে আমরা এত কম চিন্তিত, যে ‘মানুষ দেশজ নাকি বহুদেশিক টুথপেস্ট ব্যবহার করছে’-র মতো ক্ষুদ্র বিষয়ে ক্রেতা-সমীক্ষা হলেও, ‘বেড়াতে গিয়ে জিনিস কিনলে মন ভাল হয় কিনা’-র মতো অ-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমাজবিদ্যার সমীক্ষা হলেও, বাড়ির মহিলারা কেমন আছেন তার মাপকাঠি নির্ধারণের প্রয়োজন হয় না। তার একটা বড় কারণ সম্ভবত এই: মহিলাদের ভাল থাকা বা না-থাকা, মহিলাদের ক্রেতা হিসেবে প্রভাবিত করে না। মহিলারা যে সব জিনিসের ক্রেতা বলে মনে করা হয়— সুন্দর হওয়ার ক্রিম, সাবান, প্রসাধনী বা বাসনকোসন, তার বিজ্ঞাপনেও, পুরুষমানুষের চোখে তাঁকে ভাল লাগল কি না, সাবান মেখে তিনি যথেষ্ট সতেজ আছেন কি না, তাঁর পুরুষমানুষটি স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালবেসে আধুনিক প্রেশার কুকার কিনে দিচ্ছেন কি না— এগুলোই মূল বিবেচ্য। তাতেও স্বামী বা প্রেমিকটিই আসল ক্রেতা। কারণ জিনিসটা কেনা হবে বা হবে না, সে-ও তো তিনিই ঠিক করবেন। কারণ, টাকাটা তাঁর হাতে আছে। খরচের সিদ্ধান্তও। তিনিই বাড়ির সব কিছু ঠিক করে এসেছেন, তাই এগুলোও তিনিই ঠিক করবেন।

এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে মেয়েদের শীতকালে চা বা কফি করে দিতে হবে বলে আমরা মাথা ঘামাব কেন? প্রশ্নটা শুধু চা বা কফির নয়। এটা তো শুধু দিনের শুরুর চিহ্ন। তার পর সারা দিনই ভীষণ শীতে তাঁর জল ঘাঁটাঘাঁটি চলতেই থাকে। কেন, রান্না তো লোকেই করে দিয়ে যায়? আর আপনার অফিস যাওয়ার সময় খাওয়ার থালা-গ্লাস ধুয়ে খেতে দেবার সময়? আপনি অফিস থেকে ফিরলে গরম চা, জলখাবার দেওয়ার সময়? আপনার সন্তান কোচিং থেকে ফিরলে তাকে হেল্থ ড্রিংক তৈরি করার সময়ে আপনি শীতের নতুন রেকর্ড দেখছেন টিভিতে, আর উনি কিন্তু জল ঘেঁটেই চলেছেন। রান্নার মাসি বা বাসন মাজার মাসি শীত বলে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নিচ্ছেন, বাড়ির মহিলাটির কিন্তু ছুটি নেই। ‘ওই তো সে দিন, বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে দিলাম! ওকে তো রাঁধতে হল না?’ সত্যি, আপনি খুব মহানুভব। কিন্তু বাইরের খাবার খেয়ে পরের দিন পেটটা কেমন করলে মাছের ঝোলের জোগাড় কিন্তু বাড়ির মহিলাটিকেই করতে হল। সহায়িকারা এলেও বা কী, আর না এলেই বা কী— আপনার শুশ্রূষা তো থেমে থাকবে না। জানি, অপযুক্তিতে নিশপিশ করছে আপনার জিভ। এইটুকু করবে না? বাড়িতেই তো থাকে। বাস-ট্রাম ঠেঙিয়ে অফিসে তো যেতে হচ্ছে না। বাড়িতে বসে সিরিয়ালই তো দেখে। জিজ্ঞেস করে দেখুন, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ও সুযোগ দিয়ে দেখুন, তিনি ঠিক বাস-ট্রাম ঠেঙিয়ে অফিসে চলে যাবেন।

অন্তত মাইনেটা তো পাবেন। আর কয়েকটা দিনের লিস্টেড ছুটি। আপনি বরং বাড়ি বসে সিরিয়াল দেখার চেষ্টা করুন। আর শীতের লেপ-তোশক রোদ্দুরে দিন, রোদ থেকে তুলুন। সবার ছেড়ে যাওয়া অসংখ্য জামকাপড় ভাঁজ করুন। আর তার পর ভাবুন, কড়াইশুঁটিগুলো কখন ছাড়াবেন, যাতে কচুরি করা যায়।

আপনি বলবেন, এগুলো আর কী এমন কাজ? এগুলো করতে পারে এমন লোক রেখে দিলেই হল! আপনি এটা ভাবতে পারেন, কারণ আপনি তো জানেন যে এই পরিস্থিতি আসলে কাল্পনিক, আর তর্কের খাতিরে একটা লোকের কথা বলাই যায়। কিন্তু সত্যিই কি বাড়িতে থাকা মহিলাটি তাঁর সারা দিনের অসংখ্য কাজের জন্য লোক রাখার কথা বলতে পারেন? অন্তত শীতকালে? পারেন না। খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে পারেন। চাকরি করলে পারতে পারেন। ‘তোমাকে তো আর ঠান্ডার মধ্যে বেরতে হচ্ছে না’ ধরনের বাক্যবাণে বাড়ির মহিলাটিকেই বিদ্ধ হতে হয়। ‘তার উপর আবার লোকের কথা— দিব্যি তো দুপুরবেলা বারান্দায় রোদ পোয়াও!’ মার্কসীয় পরিভাষায় ক্রীতদাস আর শ্রমিকের মধ্যে পার্থক্যই তো তার কাজের বাইরের সময়টা নিজের মতো কাটাতে পারার অধিকার নিয়ে। বাড়ির মহিলাটিকে তা হলে কোন গোত্রে ফেলা যাবে? যাঁকে তাঁর বারান্দায় রোদে বসা বা সিরিয়াল দেখার কারণ দর্শাতে হয়!

না কি, শ্রমিক বা ক্রীতদাস কোনও গোত্রেই পড়েন না তিনি? কারণ তাঁর এই উদয়-অস্ত পরিশ্রমকে ‘শ্রম’ বলেই স্বীকার করি না আমরা? তাঁর শ্রম অর্থনীতির পাঠ্যবই বা তর্কের সীমার বাইরে। শ্রমের মজুরি, শ্রমের সম্মান, শ্রমের অধিকারের কথা তো পরে।

কত রকমই তো প্রতিবাদ হয় আজকাল। এমনও কোনও প্রতিবাদ হোক না— যাতে বাড়ির মহিলারা এই শীতে একটু কম কাজ করেন। কাজ করবেন না বলছি না, একটু কম করবেন। প্রাপ্য মাইনে বা ভরতুকির কথাও বলছি না। এই প্রতিবাদ শীতকালের জন্যও, আর তাঁদের উদয়াস্ত পরিশ্রমের সম্মানের জন্যও। তার নাম হোক #শীতকাল।

winter Household Women domestic activities
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy