শিল্পিত: বাজারে ক্রেতার অপেক্ষায় দেওয়ালি পুতুল। নিজস্ব চিত্র
চিনা এলইডি আলো বা ফানুস, দক্ষিণের আতসবাজি একালে দীপাবলি নাকি দেওয়ালি পালনের মূল অনুষঙ্গ। ধীরে ধীরে মাটির প্রদীপ পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রদীপের আদলে তৈরি ফাইবারের আলোর সেট জাঁকিয়ে বসেছে রাজ্যের দীপাবলির বাজারে। আলোর উৎসব পালনের জন্য পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নিজস্বতা বজায় রাখে সে সব উপকরণে তার মধ্যে একমাত্র দেওয়ালি পুতুলই নিজের জায়গা ধরে রেখেছে। পরিবর্তনের এই বাজারেও দেওয়ালি পুতুলের চাহিদা বেড়েছে। পাশাপাশি চেহারারও পরিবর্তন হচ্ছে কালের নিয়ম মেনে।
দীপাবলিতে বাড়ি সাজাতে চাই দেওয়ালি পুতুল। সাদামাটা চেহারা। বেশির ভাগের নীচের অংশ ঘাগরার মতো আচ্ছাদিত। হাতের নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। দামের উপরে হাতের সংখ্যা বাড়ে কমে। হাতে থাকে প্রদীপ বা কেরোসিনের লম্ফ লাগানোর খাঁজ। শাড়ি পরা বা পা ওয়ালা দেওয়ালি পুতুল চোখে পরে না। সাধারণত ঘাঘরা-কাঁচুলি পরা পুতুলই বেশি দেখা যায়। চেহারায় বাঙালি গড়নের থেকে অবাঙালি প্রভাবই বেশি। মেদিনীপুর শহরের আশেপাশেই দেওয়ালি পুতুল বেশি চোখে পড়ে।
দেওয়ালি পুতুলের উৎস কোথায়? এ নিয়ে নানা রকমের মত পাওয়া যায়। তবে বেশির ভাগ গবেষকের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে কোনও এক সময় অধুনা ঝাড়খণ্ডের কোনও এলাকা থেকে একদল কুম্ভকার এসে পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর, ছাতাটাঁড় ও কুক্কড়ু গ্রামে বসবাস শুরু করেন। প্রায় ৪০ বছর আগে তারাপদ সাঁতরা সম্পাদিত ‘কৌশিকী’তে গৌতম সেনগুপ্ত একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর মতে, এই পুতুল তৈরির মূল কেন্দ্র ছিল পুরুলিয়ার বলরামপুর। সেখানে বিহার থেকে আসা কয়েকজন কুম্ভকার প্রথমে এই পুতুল তৈরি করতেন। তাঁরা দু’তিন পুরুষ আগে এখানে এসেছিলেন। ধীরে ধীরে এলাকার কুম্ভকারেরাও দেওয়ালি পুতুল তৈরি করতে শুরু করেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, এই এলাকাতেই দেওয়ালি পুতুলের চল বেশি। প্রথম দিকে পুতুলের হাতে সাতটি প্রদীপ থাকত। সেই কারণে এই পুতুল সাতবহানিয়া নামেও পরিচিত।
নিজেদের রীতি অনুসারে ভিনরাজ্য থেকে আগত কুম্ভকারেরা দীপাবলির সময়ে তৈরি করতেন দেওয়ালি পুতুল। মনে করা হয়, দু’শো বছর ধরে তৈরি হচ্ছে এই পুতুল। মোটামুটি ১৮৫৭ সালে মেদিনীপুরের মির্জাবাজারের কুমোরপাড়ার পত্তন হয়। সেই সময় থেকেই মেদিনীপুরে দেওয়ালি পুতুল তৈরি শুরু হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে নানা রাজ্য থেকে এই জেলায়, বিশেষ করে খড়্গপুরে বসবাস বাড়তে থাকে। দীপাবলিতে তাঁরা রীতি অনুযায়ী দেওয়ালি পুতুল দিয়ে ঘর সাজাতেন। আর তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে। এই পুতুল যে বাংলার বাইরের কোনও এলাকার সংস্কৃতি তা নিয়ে সব বিশেষজ্ঞই একমত। তৈরির সুবিধার জন্যই হোক আর অন্য কারণেই হোক, পুতুলের কোমরের নীচের দিকে অবাঙালি গড়ন। ২০০ বছরেও তার তেমন হেরফের হয়নি। অনেক জায়গাতে একে দীপলক্ষ্মী পুতুলও বলে।
সারা রাজ্যের মধ্যে পুতুলের তালিকায় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এই দেওয়ালি পুতুল আর জো পুতুল স্থান করে নিয়েছে। কুমোরের চাকে পুতুলের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়। মাটির পুতুল তৈরি করে তারপরে তা ভাটিতে পুড়িয়ে রং করা হয়। মেদিনীপুর শহরের মির্জাবাজারের কুমোর পাড়ার শিল্পী বিশ্বরূপ পালের মূর্তির শিল্পী হিসেবে নাম রয়েছে। তাঁর বাড়িতেও তৈরি হয় এই পুতুল। তাঁর মতে, এই পুতুলের শৈলী অবাঙালি ঘরানার। তবে এখন এটা মেদিনীপুরের নিজস্ব পুতুল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এলাকারই আরেক শিল্পী দীপেনকুমার দাস। তিনি কিছুটা হলেও এই পুতুল নিয়ে নিরীক্ষা করে চলছেন। আগে গেরুয়া মাটি দিয়ে পুতুল রং হতো, চাল পুড়িয়ে, কেরোসিন তেল দিয়ে গুলে চোখ আঁকা আর চুল রং করা হতো। এখন আর সে সবের চল নেই। দীপেনবাবু চেনা ছকের বাইরে গিয়ে রাবণ, বিষ্ণুর দশ অবতার, অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন ও নানা আধুনিক শৈলীর দেওয়ালি পুতুল তৈরি করছেন। যাতে প্রকাশ পাচ্ছে সৃজনশীলতাও।
‘কৌশিকী’তেই আরেকটি নিবন্ধে দীপঙ্কর দাস জানিয়েছিলেন, এই পুতুল তৈরির রীতিতে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব পড়েছিল। তাঁর মতে, ব্রজাঙ্গনাদের আর্দশেই পুতুলগুলো তৈরি হয়। তিনি পুতুলগুলোকে পরী পুতুল বলেও উল্লেখ করেছেন। প্রায় দু’দশক ধরে এই পুতুল তৈরি হয়ে এলেও পুতুলের নির্মাণ শৈলীতে তেমন কোনও বিবর্তন হয়নি। আসলে যে পুতুল হতে পারতো নান্দনিক শিল্পকলার নিদর্শন তা কারুশিল্প হয়েই থেকেই গিয়েছে। তবে কলকাতার অনেক পুজো মণ্ডপ আজকাল এই পুতুল দিয়ে সেজে ওঠে। মনে পড়তেই পারে, পার্ক সার্কাস কানেক্টরের পরমা আইল্যান্ডের প্রায় ৩৭ ফুট উঁচু ভাস্কর্যটির কথা। বাইপাসের আদি যুগে, ১৯৮৭ সালে শানু লাহিড়ীর নেতৃত্বে দেওয়ালি পুতুলের আদলে তৈরি হয়েছিল সেটি। নাম দেওয়া হয় পরমা। ধীরে ধীরে এলাকাটিও পরমা আইল্যান্ড নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। উন্নয়নের ধাক্কাতে তা বেশ কিছুদিন আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
মির্জাবাজারের কুমোরপাড়ার দেওয়ালি পুতুলের কারিগরেরা কেমন আছেন? পাড়া ঘুরলে জানা যায়, পুতুলের চাহিদা কিছুটা হলেও বেড়েছে। এলাকার শিল্পী সুতপা পালের পর্যবেক্ষণ সেরকমই। গোটা পাড়ায় ৮০-৯০টি পরিবারের বাস। বছর দশেক আগেও বেশ কিছু মাটির বাড়ি চোখে পড়ত এলাকায়। কিন্তু এখন সেখানে পাকা বাড়ির সংখ্যাই বেশি। তবে সবটাই যে দেওয়ালি পুতুলের কারণে তা নয়। কুমোরেরা সারা বছর মাটির নানা জিনিসপত্র তৈরি করেন। পুজোর আগে আগে মাতেন দেওয়ালি পুতুল তৈরিতে। অনেক সময়ে কারও কারও কাছে কলকাতার শিল্পী বা বড় শিল্পীরা এক সঙ্গে অনেক পুতুলের বরাত দেন। বিভিন্ন মণ্ডপ সজ্জায় কাজে লাগে সেই পুতুল। তবে সেই পুতুল তৈরি করতে হয় বরাত দেওয়া শিল্পীর ইচ্ছে অনুযায়ী। তাঁরাই পুতুলের নকশা এঁকে দিয়ে যান। তাতে পুতুলের ছাঁদে কিছুটা বদল আসে। তবে বরাতের পুতুলে ভাল দাম মেলে।
কুমোর পাড়ায় কোনও সমস্যা কি নেই? শিল্পীদের কথায়, দেওয়ালি পুতুল তৈরি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মতো শিল্পীর অভাব। সাধারণত বাড়ির মহিলা বা ছোটরাই পুতুল তৈরিতে সময় দেন। ছোটরা বড় হয়ে যাওয়ার পর সেই জায়গা নেয় অন্য কোনও শিশু। তাই শিল্পীদের নজরে তেমন ভাবে পড়ে না দেওয়ালি পুতুল শিল্প। তাই গড়নে এখনও আদি রূপ ধরে রাখতে পেরেছে পুতুলগুলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy