Advertisement
E-Paper

প্লাস্টিক-দূষণ নয়, আরও গভীর পচন! দ্রুত বদলে যাচ্ছে গর্বের জনপদগুলোও

ধর্ষণের মতো অসামাজিকতাও যদি মেনে নেওয়া হয়, তা হলে সমাজের অস্তিত্ব নিয়েই ভাবনা জাগে, দুশ্চিন্তা তৈরি হয়! লিখছেন অমিতকুমার দেধর্ষণের মতো অসামাজিকতাও যদি মেনে নেওয়া হয়, তা হলে সমাজের অস্তিত্ব নিয়েই ভাবনা জাগে, দুশ্চিন্তা তৈরি হয়! লিখছেন অমিতকুমার দে

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:০৫
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

একসময় প্লাস্টিক-বিরোধী কর্মসূচিতে মিছিলে হেঁটেছি, দোকানে দোকানে গিয়ে লিফলেট ধরিয়েছি। বাজার-ফিরতি মানুষজনকে পথ আটকে বুঝিয়েছি, যেন তাঁরা আর প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ না নেন। আরও অনেকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে, দারুণ কিছু একটা করছি!

এখন নিজেকেই মূর্খ বলে মনে হয়! দু’দিন প্লাস্টিক বন্ধ থেকেছে, আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে! পরে ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছে, সরকার চাইলে তো প্লাস্টিক তৈরির কারখানাগুলোকে বন্ধ করে দিতেই পারে! কোনও আন্দোলন বা প্রচার কিছুই প্রয়োজন হয় না! কিন্তু তা তো হয় না! প্লাস্টিক নিয়ে মাঝেমাঝেই ঝড়ঝাপটা ওঠে, আবার থিতু হয়ে যায়! দশকের পর দশক তাই দেখছি!

এ লেখার বিষয় প্লাস্টিক-দূষণ নয় অবশ্য। আরও গভীর পচন! এ লেখা যখন লিখছি, তখন আমাদেরই এক আদিবাসী বোন যৌনাঙ্গে লোহার রডের ভয়াবহতা নিয়ে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে শুয়ে আছেন! তাঁকে ধর্ষণ করেও ক্ষান্ত হয়নি বীরপুঙ্গব! এবং ভয়ঙ্কর সেই কাজের জন্য নাকি একটুও অনুতপ্ত নয় সে! কোনও বিকার নেই তার মধ্যে! নির্বিকার ভাবে স্বীকারও করে নিয়েছে কৃতকর্ম। সংবাদপত্র পড়ছি আর শিউড়ে উঠছি! আমি ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে উঠছি আমার ছাত্রীদের কথা ভেবে! আমার আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবী আর তাঁদের মেয়েদের কথা ভেবে!

আদিবাসী মেয়েটির ধর্ষণে পুলিশ যে ভুমিকা নিয়েছে, যে ভাবে দ্রুত অপরাধীদের পাকড়াও করে চার্জশিট দাখিল করেছে, তা প্রশংসনীয় হলেও অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। ঘুমোতে দিচ্ছে না রাতে।

আমাদের গর্বের জনপদগুলোও কেন এভাবে দ্রুত পাল্টাচ্ছে, কেন এ সব দুরারোগ্য ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই শান্ত শান্তিবলয়েও? চা-বাগিচা, অরণ্য, নদী, পাহাড়, পালাগান, ভাওয়াইয়া, ধামসা-মাদল, চাষ-আবাদ নিয়ে আমাদের কী সুন্দর ঘরকন্না যুগের পর যুগ! প্রকৃতি এখানে মনে ছায়া ফেলে বলে মানুষ সহজ-সরল! গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে আত্মীয়তার সুবাতাস! মানুষ মানুষকে ভালবাসা-সম্মানে জড়িয়েই তো বাঁচত এখানে এতদিন!

যে কিশোরী বা তরুণী চা-বাগানের নির্জনতায় গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেত, বনে জ্বালানি আনতে যেত, তাকে তো ধর্ষিত হতে হয়নি এতকাল! আমরা বছরের পর বছর কত নির্জনে নির্ভয়ে তাঁদের ঘুরে বেড়াতে দেখেছি! বালিকারা নিঃসঙ্কোচে খেলে বেড়িয়েছে খোলা প্রান্তরে। তাদের বাবা-মায়ের ভয় হয়নি! অথচ কী দ্রুত

বদলে যাচ্ছে সব!

আমার মেয়ে স্কুল থেকে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আক্রান্ত হয়। যে এলাকায় আমি থাকি, সেখানেও একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা সমস্ত বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে। অসুখটা কত গভীরে, তার নাড়াঘাটা প্রয়োজন। সামাজিক মাধ্যমের বিপ্লব বা দু’দিনের মিটিং-মিছিলে কিছুই হবে না! সূচনায় প্লাস্টিকের প্রসঙ্গের উত্থাপন

সেই কারণেই!

গ্রামে চাকরি করি। কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়। বাইক চালাতে চালাতে অস্বস্তি হয়। অন্ধকারে রাস্তার পাশে, বাঁশঝোপে, কালভার্টে একটি-দু’টি মোবাইল ফোন আর অনেকগুলি মাথা, পৃথিবী ভুলে তারা কীসে মশগুল? জানি না সত্যিই হবে কি না, সদ্যই খবরে পড়লাম, অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ছবি-ভিডিও সংবলিত পর্নোগ্রাফির জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলির ওপর নাকি নিষেধের আইন আসছে। নাকি ৮২৭টি পর্নোসাইট বন্ধ করে দেওয়া হবে। ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ এনে বিস্তর আলোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছে! কিন্তু এটা বাস্তব, মুঠোফোনের দৌলতে যৌন ভিডিও-অডিও যেভাবে অল্পবয়সিদের হাতে হাতে চলে গিয়েছে, তার খেসারত দিতে হচ্ছে সমাজকে! স্কুল স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত কেন মনীষীদের বিষয়ে পড়ানো হবে না, তা নিয়ে কোনও জোরাল দাবি তৈরি হয় না, অথচ যৌন-সাইট বন্ধ হলে বিস্তর জলঘোলা হবে! লজ্জা হয়! এক দিকে পর্নোগ্রাফি, অন্য দিকে মদ-মাদক ভয়ঙ্কর ভাইরাসের মতো ছড়াচ্ছে! ভোটের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নেশাদ্রব্য ছড়াচ্ছে! এর চেয়ে করুণ দুর্ভাগ্য গণতন্ত্রের আর কী হতে পারে? গ্রামগঞ্জে নেশাদ্রব্যের ফোয়ারা বইছে! বছর জুড়ে পুলিশি টহলদারি নেই কেন? পুলিশ কোনও অপরাধীকে পাকড়াও করলে তার জন্য তদ্বির শুরু হয় কেন? দোষীকে শাস্তি পেতে না দিলে অপরাধ তো বাড়তেই থাকবে!

সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হল, বড়রাও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে ভুলে যাচ্ছেন ক্রমাগত! কেউ কোনও প্রতিবাদ করেন না! ইভটিজার বুক ফুলিয়ে মোটরবাইক নিয়ে তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছে, তাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না! ঘরের পাশেই নেশার আসর বসালে, নীলছবির আসর বসালেও কেউ প্রতিবাদ করছেন না! ছেলের আচরণে হঠাৎ এত বিস্তর পরিবর্তন হল কেন, অভিভাবকেরা তা দেখছেন না, দেখলেও না দেখার ভান করছেন! যে সম্মান মাসিমা-কাকিমা-পিসিমারা পেতেন, তাও নিমেষে উধাও! যে বয়সের নারীই হোন না কেন, তাঁকে শরীর ভিন্ন আর কিছুই ভাবা হচ্ছে না! এই সঙ্কট দেখেও যদি না দেখার ভান করি আমরা, তা হলে তাকে নিজেদের পায়ে নিজেদের কুড়ুল মারাই তো বলে!

সহজলভ্য হয়ে উঠেছে অনেক কিছুই। বনে-বাদাড়ে বিস্তর ঘুরে বেরিয়েছি, ঘুরে বেড়াই। কিন্তু এখন ভয় হয় বন বা নির্জনতায় যেতে। পর্যটন অনেকাংশেই রূপান্তরিত হচ্ছে যৌন-পর্যটনে। জঙ্গলে বাইক-রোমিওদের বাড়াবাড়ি উদ্বেগের। অসুস্থ মানসিকতা সংক্রামক হচ্ছে ডুয়ার্সেও! প্রশাসন নড়ে না বসলে, পর্যটনচিত্রটাই কলুষমাখা হয়ে উঠবে!

অবাক হয়ে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখছিলাম আমার কৈশোরের শহরে। নেশাবস্তু, অশ্লীল নাচ আর ডিজের তাণ্ডবে অস্থির লাগছিল! রেড রোডের পুজো কার্নিভাল মুগ্ধ করেছে আমাদের, কিন্তু সারা বাংলার ছবিটা তো তা নয়! এ সবে কি প্রশাসনের কিছুই করার নেই? মেলায় বসছে জুয়ার আসর, পুলিশের সঙ্গে চলছে লুকোচুরি খেলা! চাইলে কি এসব একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যায় না?

এক একটি অন্যায়ে একে অন্যের সঙ্গে হাত মেলানো! যেন একটা জাল! অপরাধের মাকড়শাগুলো কী দ্রুততায় জাল বাড়িয়ে চলেছে! কথার ধরন পালটে যাচ্ছে,

সেলফি-মানবমানবীরা হালকা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে ভাবছেন, এই মুহূর্তটাই শ্রেষ্ঠ! আর আমাদের আদিবাসী বোনটির কান্না ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট ছাড়িয়ে আরও অনেকের মধ্যে দলা পাকাবে, তাঁর নিষ্পাপ শিশুগুলো ‘ধর্ষণ’ নামক ভয়ঙ্কর শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বড় হবে! এ লজ্জার ভার কে নেবে? কবে বন্ধ হবে, আদৌ কি বন্ধ হবে এসব জান্তব লালসা? জান্তবই-বা বলি কেন! জন্তুরা এমন করে না, মানুষই করে! আবার মানুষকে ঘৃণা করেই-বা বাঁচি কী করে! সমাজ কি আর ভরসাস্থল

হয়ে উঠবে না?

জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসুক ওই আদিবাসী মেয়েটি! আমরা অপেক্ষা করছি! তাঁর আরোগ্যের জন্য, গোটা সমাজের আরোগ্যের জন্য!

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Rape ধর্ষণ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy