Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
ছোট থেকে বড় হওয়া মানে কার্টুন থেকে ইমোটিকন

গল্প বলার লোকগুলো সব কোথায় গেল

আপনার মুখ যদি কার্টুন চরিত্রদের সঙ্গে কম্পিটিশনে হেরে যায়? যদি না পেরে ওঠে ততটাই মজার গল্প বলতে? না এঁটে উঠতে পারে ওই সব অদ্ভুত নাচনকোঁদনের সঙ্গে? তা হলে আপনার সন্তানের চোখ দুটি আবার ফেরত চলে যাবে টিভির পরদার দিকে। সেঁটে যাবে স্ক্রিনে।

শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী।

শিল্পী: সুব্রত চৌধুরী।

যশোধরা রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

আপনার ছোট্ট মেয়ে, বছর তিনেক, টিভির সামনে বসে আছে। টিভি স্ক্রিনে একপাল মূর্তি। অ্যানিমেশনের মুখ। যারা তাকে গল্প বলছে। ঘুম থেকে ওঠানোর সময় আপনি টিভিটা চালিয়ে দিতেই হাউমাউ করে তারা তার মানসপটে ঝাঁপাচ্ছে। এই সব চরিত্ররাই তাকে খাবার সময় গল্প বলছে। কারণ আজকাল কার্টুন না দেখতে দিলে সে খায় না। আবার কার্টুন দেখতে দেখতেই, সে খেতে ভুলেও যায়। চিবোতে ভুলে যায়। ঢোক গিলতে ভুলে যায়। যে ভাবে রাতে সে ঘুমোতেও ভুলে যায়। কার্টুনের ওই মুখগুলো তাকে দেশবিদেশের গল্প শোনাচ্ছে। মেয়ে খিলখিল করে হাসছে। বন্ধু হয়ে যাচ্ছে ছোটা ভীম, টম অ্যান্ড জেরি। ফাঁকা ঘরে বসে সে কার্টুন গেলে। টিভির দিকে তাকিয়ে অপলক। আপনি ঘরে ঢুকতেই আপনার দিকে তাকায় সে। খোঁজে। কী খোঁজে? খোঁজে আপনার মুখের রেখা, অভিব্যক্তি। এক্সপ্রেশন। মজা, হাসি, চোখের তাকানো। ভঙ্গি। কার্টুনের মুখগুলোর থেকেও যদি আপনার মুখটা ইন্টারেস্টিং হয়, সে আপনার কথা শুনবে, দেখবে। ভাববে।

আর আপনার মুখ যদি কার্টুন চরিত্রদের সঙ্গে কম্পিটিশনে হেরে যায়? যদি না পেরে ওঠে ততটাই মজার গল্প বলতে? না এঁটে উঠতে পারে ওই সব অদ্ভুত নাচনকোঁদনের সঙ্গে? তা হলে আপনার সন্তানের চোখ দুটি আবার ফেরত চলে যাবে টিভির পরদার দিকে। সেঁটে যাবে স্ক্রিনে। সাঁৎ করে টেনে নেবে টিভি আবার আপনার মেয়েকে, তার মনকে।

টিনেজার হতে হতে, সেই মেয়েকে আনন্দ আর দুঃখ, রাগ আর হাসি, বার্তায় বার্তায় জানাচ্ছে ইমোটিকনেরা। কার্টুনের নতুনতর অবতার তো এরাও। গোল মুখ। গোল গোল চোখ। এরাই ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে, হোয়াটস্যাপে, হাইকে ওকে জানাচ্ছে। অনুভূতিই নাকি জানাচ্ছে।

বন্ধুদের আসল মুখ হঠাৎ যেন ইমোটিকনের মুখ হয়ে যাচ্ছে।

গত কুড়ি বছর ধরে, পঁচিশ বছর ধরে এই সব ঘটছে। আর এই ঘটনা ঘটার পাশাপাশি আসলে আর একটা ঘটনাও ঘটে গেছে। আসল মানুষের মুখগুলো হাপিশ হয়ে গেছে। মামা মাসি কাকা জ্যাঠা দাদু ঠাকুমা দিদিমারা হাপিশ হয়ে গেছেন, যে ভাবে ক্রমশ হাপিশ হচ্ছে মোড়ের দাদা, মাসতুতো দিদি, পাড়ার মাসিমা, বেপাড়ার বউদিরা। যারা, ছোটদের কাছে মানুষ হওয়ার রোল মডেল ছিল। অ্যানিমেশন কার্টুন ছিল না। তড়বড় করে কথা বলে যাওয়া আসল রক্তমাংসের মানুষ ছিল। ছোটদের কাছাকাছি বসে যারা গল্প শোনাত, রামায়ণ মহাভারতের কাহিনি থেকে শুরু করে রূপকথা। যারা সমাজে চলার পথের হদিশ দিত। দুষ্টুমি করত। মিথ্যের সঙ্গে সত্যির তফাত বোঝাত। বোকা আর চালাকের তফাতও।

এর সঙ্গে সঙ্গে হাপিশ হল তারা, যারা বিজ্ঞানের জগতের স্বপ্ন দেখাত, সেই সব পাড়ার স্যর, পাশের বাড়ির পণ্ডিত মানুষটি। সিধুজ্যাঠা এখন গুগল। আর, হ্যাঁ, বিশ্বকোষ ধরনের বই, ডিকশনারি, যা আমাদের জুগিয়ে দিতেন বাবা মা বা জ্ঞানী দাদারা, দু’চারটে
গাঁট্টা ও ‘কিছুই তো জানিস না’ মন্তব্য-সহ, সেগুলোও গেছে ।

আর গেছে সেই সব বন্ধুরা। যারা সাপ্লাই দিত গল্পের বই। কোথায় গেল হাত থেকে হাতে ফিরতি হওয়া, স্মাগল করা, পড়ার বইয়ের নীচে লুকিয়ে পড়া কানদোমড়ানো বই! বইয়েরাও গেছে।

কী ঘটত ওই বছর কুড়ি বা তিরিশ আগে?

বৈঠকখানা থেকে চণ্ডীমণ্ডপ, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান থেকে কলেজ ক্যান্টিন, রান্নাঘরের উনুনের আশপাশ থেকে খাবার টেবিল, এমনকী দরজার সামনেটা, বারান্দার ধাপিটা, ছাতের সিঁড়িটাও ছিল মানুষের মুখে মুখে আশ্চর্য সব ছবি আর গল্পের গজিয়ে ওঠার জায়গা। গল্প গজাত মুখে মুখে এবং একাধিক মানুষের সংযোগ স্থলে। সেই সব গল্পের অনেকটাই বলা হত বড় বড় চোখ করে, হাত পা নেড়ে এবং ঠোঁট জিভের অদ্ভুত সব ঘর্ষণে। গল্প বলা, গুল দেওয়া, আড্ডায় রাজা উজির মারার এক একটা রকম থাকত এক এক জনের। আর অনেক লোকের মধ্যে এক এক জন হত সে আড্ডার মধ্যমণি। বাংলা সাহিত্যের অনেকটাই আবার এই সব বৈঠকি আড্ডার বিবরণের মতো, আর তাই উপভোগ্য। পরশুরামের গল্পে ফরাস পাতা বৈঠকখানা ঘরের আড্ডা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্পে মেসবাড়ি। গৌরকিশোরের ব্রজবুলির কাহিনি। সত্যজিৎ রায়ের তারিণী খুড়োয় এসে শেষ হয়েছে।

এই গল্প বলা আর গল্প শোনার ট্র্যাডিশন কিন্তু কেবল আমাদের জীবনের বাইরের দিকে ছিল না। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেত শোনার মধ্য দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। যা কিছু মনে পড়ে, স্মৃতি বলতে যা বুঝি, আসলে সবই কারও না কারও মুখে মুখে গল্পকথায় শোনা। যদি এত গল্প না শুনতাম তা হলে আমাদের যৌথ স্মৃতি বলে কিছুই থাকত না। আশ্চর্য ভাবে, ছোটবেলা সম্বন্ধে যা যা মনে করতে পারি, সে সব স্মরণের আদ্ধেক হল বড়দের মুখচ্ছবি আর সেই মুখনির্গত আওয়াজের স্মৃতি। তাঁরা গল্প বলছেন, সে সব গল্পের মধ্যে অডিয়ো-ভিশুয়াল, অর্থাৎ দৃশ্য শ্রাব্য দুটো বস্তুই খুব মনোরমভাবে পেশ হচ্ছে। অর্থাৎ শুধু শ্রবণ না, আমাদের চোখ এবং কখনও বা স্পর্শও সেখানে কাজ করেছে। মনের মধ্যে ছেপে বসে গেছে কাহিনি বা কথাগুলো ছবির মতো। পিসি, মামু, কাকু, মা বাবা, দিদা, ঠাকুদ্দা, সবাই খুব গল্প বলতেন। সে সব বলার সময়ে তাঁদের নাসারন্ধ্র স্ফুরিত হত, চক্ষু বিস্ফারিত হত, মুখ দিয়ে নানা আওয়াজ করতেন তাঁরা, হাত নেড়ে নানা আকার আকৃতি দেখাতেন— টোটাল এন্টারটেনমেন্ট প্যাকেজ। অ্যানিমেশনের চূড়ান্ত। সে সব গল্প শুধুই পারিবারিক উচ্চতার কাহিনি না, শুধুই নিজেদের হারিয়ে ফেলা পুকুর আর ধানের মরাই আর দুধ ঘি-পরিপূর্ণ গৌরবান্বিত অতীতের গল্প না। সে সব কাহিনিতে অনেক পরত, অনেক শেখা, অনেক আনন্দ।

চোখ গোল গোল করে সেই সব গল্প শুনতাম। স্পষ্ট মনে পড়ে একেবারে শৈশবের এমন সব আড্ডাকথনের দৃশ্য, স্মৃতিতে যা মুদ্রিত। হয়তো মফস্সলের দিকের এক দিদা-র বাড়ি। রাত হয়ে আসছে, লোডশেডিং হয়েই আছে, হ্যারিকেনের আলো টিপটিপ করছে, মশা উড়ছে, বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকা ঝিঁ ঝিঁ করছে, তার মধ্যে বুঁদ হয়ে গল্প শুনছি। হাত তালি দিয়ে গাইছি কোন ছড়া, সুর করে বলছি কোন কবিতা। উচ্চিংড়েকে দেখে ভয় যাতে না পাই, দিদা শিখিয়ে দিচ্ছেন, উচ্চিড়িঙ্গা উচ্চিড়িঙ্গা মেরে সাথ তু লড়েঙ্গা?

এই অনুভূতির কি কোনও তুলনা হয়? কোথায় লাগে টিভি সিনেমা এন্টারটেনমেন্ট! এখন আমাদের বাচ্চাদের কাছে কার্টুন নেটওয়ার্ক আছে। একটা চ্যাপ্টা স্ক্রিন তাদের দাদু দিদা কাকা মামার জায়গা নিচ্ছে। তারা ট্যাব থেকে ফোন থেকে পড়ছে গল্প, যা করছে সব একা একা একা। আমরা নিজেরা বাবা মা হিসেবে ব্যস্ত খুব। আমার মেয়েকে তবু তার বাবা রোজ রাতে একটা করে গল্প বলত ঘুমোবার আগে। রোজ নতুন একটা। কম্পিটিশনে সে টিকে যেতে চেয়েছে। কার্টুনদের কাছে হেরে যেতে চায়নি।

বাচ্চাদের ছোট্ট থেকে বড় করার সময়, মুখে মুখে, হাত পা নেড়ে, চোখ পাকিয়ে, গল্প বলাটা সত্যিই দরকার। নইলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আমাদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করার মতো কিছুই থাকবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cartoon Animation Emoticons ইমোটিকন
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE