Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

এক মা ও তাঁর নিজের আকাশ

হে মন্তের ছায়া যে এত ধূসর হতে পারে, আগে কখনও বোঝেনি সেই বালক!— বিবর্ণ পুজো গিয়েছে ক’দিন হল। পুজোয় তার একটা জামা হয়েছে, ববি জামা, মা কিনে এনেছিল ষষ্ঠীর সন্ধ্যায়। লিখছেন তাপস সিংহহে মন্তের ছায়া যে এত ধূসর হতে পারে, আগে কখনও বোঝেনি সেই বালক!— বিবর্ণ পুজো গিয়েছে ক’দিন হল। লিখছেন তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

হে মন্তের ছায়া যে এত ধূসর হতে পারে, আগে কখনও বোঝেনি সেই বালক!— বিবর্ণ পুজো গিয়েছে ক’দিন হল। পুজোয় তার একটা জামা হয়েছে, ববি জামা, মা কিনে এনেছিল ষষ্ঠীর সন্ধ্যায়। সে বছরের সেরা হিট ছবি ‘ববি’র নায়ক ঋষি কপূর যে বুটি বুটি জামা পরেছিল, সে রকম। তার মায়ের অবশ্য কিছুই হয়নি। অফিস বন্ধ। শুধু জেনেছে, পুজোর মুখে তার মাকে কোম্পানি কিছু টাকা বোনাস হিসেবে দিয়েছিল। সে দেখেছে, মায়ের অফিস মাঝে মাঝে তালা পড়ে। তিন মাস বাদে এক মাসেরও কম বেতন মেলে, কখনও কখনও বেশ কয়েক মাস একেবারে কিচ্ছুটি নেই। তার ইস্কুলের মাইনে বাকি পড়ল, পাড়ার মুদির দোকান ধার দেওয়া বন্ধ করে দিল, মায়ের লেখা ফর্দ হাতে নিয়ে শুকনো অপমানিত মুখে সে বাড়ি ফেরে, সব শুনে তার মায়ের চোয়াল ক্ষণিকের জন্য কঠিন হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। হেসে বলে, ‘যাক গে, দেখ না, আমরা কী রকম নতুন মেনু বানাই! ‘আবোল তাবোল’টা পড়া শুরু করলি?’

তার মামারবাড়ি খুবই সম্পন্ন, যৌথ পরিবার, অনেক মানুষজন সেখানে। তবুও তার মা যে কেন তাকে নিয়ে আলাদা মানুষ করে, সে বোঝে না! বোঝে না, তার মাকে এত কষ্ট করেই বা চাকরি করতে হবে কেন? তার চার পাশের আর কোনও মাকে তো সে চাকরি করতে দেখেনি! একটু বড় হয়ে সে জেনেছে, মা তার দাদুকে বলে এসেছে, ‘আমাকে আমার মতো ছেলেকে বড় করতে দিন। আপনারা তো আছেনই। কিন্তু আমি নিজের চেষ্টায় দেখি না!’ কে জানে, মাত্র চব্বিশের কলজেতে এত দম কোথা থেকে আসে?

খুব ভোরে ঘড়ির চিরকালীন কর্কশ অ্যালার্মে ঘুম ভাঙত তার। ভোরের ইস্কুল। তার মা ধড়ফড় করে উঠে উনুনের কয়লা বেছে নতুন গুল-কয়লা দিয়ে আঁচ ধরাত। কয়লার ধোঁয়া পাইপ দিয়ে বেরোত বটে, কিন্তু তাদের চিলতে কোয়ার্টার্সের হাওয়া বড্ড ভারী করে দিত, তার আর তার মায়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মতোই— ‘ওঠ, উঠে পড়, আর কখন ইস্কুলে যাবি? পড়াশোনাটা তা হলে ছেড়েই দে!’ বলত, আর অভ্যস্ত তৎপর হাতে সেই বালকের ইস্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে, টিফিন বাক্স ভরে (বেশির ভাগ দিনই বড়ুয়ার টিফিন কেক), জলের বোতল, জামাপ্যান্ট এগিয়ে রাখা— সেই বালককে কোনও ক্রমে তুলে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাস ধরে ইস্কুলে পৌঁছে দিয়ে আবার যখন ছুটতে ছুটতে সামান্য বাজার করে বাড়ি ফিরত, উনুন জ্বলে খাক! রান্না করে, ছেলের জন্য ভাত বেড়ে রেখে, নিজের টিফিন বানিয়ে দৌড়ে দৌড়ে সাড়ে ন’টার মধ্যে অফিস! লেট হলে বড়বাবু চিৎকার করতেন, ‘ছেলে মানুষ করতে হলে বাড়ি বসে থাকুন, না হলে হস্টেলে পাঠান! লেট করলে আর আসার দরকার নেই।’ কোনও কোনও নির্বান্ধব গভীর রাতে সেই ছেলের মা তাকে আঁকড়ে হুহু করে কেঁদে বলত, ‘ওরা কি জানে, কেন তোকে আমি কাছে রেখে মানুষ করার চেষ্টা করছি? কেন তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেল? তুই তাড়াতাড়ি বড় হতে পারিস না?’

কে বলল, পারে না? জীবন সেই বালককে ঘাড়ে ধরে বড় করে দিচ্ছিল। তার মা তাকে বুঝিয়েছিল, ভাত খেয়ে এঁটো থালা তাকেই তুলতে হবে, শুধু ‘বাড়ির বউ-মেয়ে’রাই কেন থালা তুলে এঁটো মুছবে? মা বলত, মেয়েদের কাজ বলে আলাদা করে কিছু হয় না, সব কাজই মিলিত ভাবে ছেলে আর মেয়েদের! তার চার পাশের গেরস্থালি তাকে কখনও এ কথা শেখায়নি, সেখানে মেয়েরা মানে ‘ঘরের কাজ’ আর ছেলেরা মানে অফিস-আড্ডা-তাস-রেডিয়োয় বিবিধ ভারতী! তার মা যেন কেমনধারা! সে দেখেছে, তাদের হা-হা দারিদ্রের সংসারেও কত মানুষকে গোপনে সাহায্য করত সেই নারী।

এক কঠিন আর বিষণ্ণ রাতে তার মা তাকে কাছে ডাকল। সেই বালক তত দিনে কিশোর। মায়ের হাতে চেকবই। ‘শোন, আমি কয়েকটা চেকের পাতায় সই করে দিয়ে যাচ্ছি। বেশি কিছু নেই, তবু কয়েকটা দিন টানতে পারবি।’ মায়ের কথায় আর্তনাদ করে ওঠে সে। ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ মা? কী হয়েছে তোমার?’ যে হাসি দেখলে সে ছেলের আকাশে রামধনু ডানা মেলে, সেই হাসি মায়ের মুখে, ‘কাল নার্সিংহোমে ভর্তি হতে হবে রে। একটা কঠিন অপারেশন হবে আমার। বড্ড কঠিন। যদি না ফিরি, তাই। তুই পড়াশোনাটা ছাড়িস না, যে ভাবে হোক চালিয়ে যাস।’ তাদের চিলতে কোয়ার্টার্সের বাথরুমে ঢুকে জোরে কল খুলে দিয়ে সেই কিশোরের গোমরানো কান্না এই ফাগুনের রাতে আজও কানে বাজে। তবু, তার মধ্যেও সেই কিশোরের বেশ গর্ব হল! কই, আর কারও মাকে তো সে চেকে সই করতে দেখেনি! তার মা আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা?

তিন বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে সেই নারী তার ওড়ার আকাশ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিল! উচ্চকণ্ঠে নয়, গোটা জীবন ধরে নিজস্ব ভাষায় মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলে চলল সেই নারী!

তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। বনস্পতির ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Women's Day Special
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE