অনুমান করা যায়, রঘুরাম রাজনের উপর নরেন্দ্র মোদীর রাগ আরও এক পর্দা চড়িবে এবং সেই ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ তাঁহার পারিষদদলের ও ভক্তবৃন্দের মনে দাবানল সৃষ্টি করিবে। অতঃপর সমাজমাধ্যমে এবং অন্য পরিসরে তাঁহার উদ্দেশে রকমারি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হইলেও বিস্ময়ের কারণ নাই। যাঁহাদের ভাণ্ডারে সদুত্তরের ঘোর অনটন, প্রশ্ন শুনিলে তাঁহারা কুপিত হইবেনই। অথচ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর এই মরসুমে যে প্রশ্নটি তুলিলেন, তাহা কেবল সঙ্গত নহে, অত্যন্ত জরুরি। বস্তুত, প্রশ্নটি তাঁহার একার নহে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার সরকারের প্রতি যাঁহাদের প্রশ্নহীন আনুগত্য, যাঁহারা মোদীজির মন কি বাত কানে আসিবামাত্র জপ করিতে বসেন ‘যাহা শুনিলাম সত্য শুনিলাম, সত্য বই মিথ্যা শুনিলাম না’, তাঁহাদের কথা ছাড়িয়া দিলে, যে কোনও কাণ্ডজ্ঞানী নাগরিক বেশ কিছু কাল ধরিয়া যে সংশয়ে উত্তরোত্তর তাড়িত হইয়া আসিতেছেন, রঘুরাম রাজন তাঁহাদের মন কি বাত উচ্চারণ করিয়াছেন।
প্রশ্নটি সহজ ও স্পষ্ট: ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) তথা জাতীয় আয় বছরে ৭ শতাংশ বাড়িতেছে বলিয়া যে সরকারি দাবিটি অধুনা মন্ত্রী-পারিষদরা যত্রতত্র আওড়াইয়া বেড়াইতেছেন, তাহা কি বাস্তবসম্মত? জাতীয় আয় কি সত্যই ৭ শতাংশ হারে বাড়িতেছে? রাজন এই প্রশ্নটি তুলিয়াছেন একটি বিশেষ উপলক্ষকে ব্যবহার করিয়া। মোদী জমানায় কর্মসংস্থানের দুরবস্থা লইয়া সমালোচনা তীব্র হইতে তীব্রতর, কর্মহীনতার নানা পরিসংখ্যান প্রকাশিত হইয়াছে, সরকার সবটা চাপিয়া দিতে পারে নাই। এই সমালোচনাকে প্রতিহত করিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সম্প্রতি মন্তব্য করিয়াছেন, জিডিপি বছরে ৭ শতাংশ বাড়িতেছে, অথচ কর্মসংস্থান বাড়িতেছে না— ইহা কী রূপে সম্ভব? মন্তব্যটি কিঞ্চিৎ নাবালকোচিত, কারণ ‘জবলেস গ্রোথ’-এর সমস্যা কেবল ভারতে নহে, বিশ্বব্যাপী বহু আলোচিত। জেটলি মহোদয় হয়তো সেই সকল আলোচনা সম্পর্কে অবহিত হইবার সময়-সুযোগ পান নাই। কিন্তু রঘুরাম রাজন আপাতত সেই আলোচনায় যান নাই। (নাম না করিয়া) কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে তাঁহার তাৎপর্যপূর্ণ সংশয়বাক্য: একটি সম্ভাবনা হইল, জাতীয় আয় হয়তো আদৌ ৭ শতাংশ হারে বাড়িতেছেই না!
যে কোনও জমানাতেই সরকারি পরিসংখ্যান— সাহেবি কেতায় বলিলে— কিঞ্চিৎ ‘লবণ সহযোগে’ সেবন করা বিধেয়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর পাঁচ বছরে সরকারি পরিসংখ্যান এবং সেই পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও পরিবেশনের গোটা বন্দোবস্তটি লইয়া যে ভাবে ছেলেখেলা করা হইয়াছে, তাহাকে অভূতপূর্ব বলিলে অত্যুক্তি হয় না। সরকারি পরিসংখ্যান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় নাই এবং সদস্যরা কমিশনের পদ হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়াছেন— এমন ঘটনাও দেখিতে হইয়াছে। জাতীয় আয় হইতে শুরু করিয়া কর্মসংস্থান, বিভিন্ন বিষয়ে সরকার কত বার কত রকমের তথ্য প্রচার করিয়াছে ও ক্ষেত্রবিশেষে গোপন করিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। তথ্য গোপন ও বিকৃতির অভিযোগগুলি উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। এই প্রবণতা বিপজ্জনক। ইহার ফলে কেবল অর্থনীতির স্বাস্থ্য বা সমস্যা বুঝিবার কাজটি ব্যাহত হয় না, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ একটি গণতান্ত্রিক দেশে অর্থনীতির খতিয়ান বিশদভাবে ও সুষ্ঠুভাবে জানিবার অধিকার নাগরিকের প্রাথমিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এই উদ্বেগের প্রেক্ষাপটেই রঘুরাম রাজন বলিয়াছেন, একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানকে দিয়া প্রয়োজনীয় তথ্য পরিসংখ্যান নূতন ভাবে যাচাই করিয়া বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট তৈয়ারি করা দরকার। বর্তমান শাসকরা এই সুপরামর্শে কর্ণপাত করিবেন, এমন ভরসা কিছুমাত্র নাই। আপাতত ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy