নির্বাচনী প্রচারের সময় ইমরান খান চিৎকার করে বলেছিলেন, হে মোদী, ভাববেন না এ দেশে সবাই নওয়াজ় শরিফ, ব্যবসার জন্য দেশকেই ভুলে যাবে; বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধা করে, কারণ তারা দেশপ্রেমিক। এর পর প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেই ‘ক্যাপ্টেন’ ইমরান বললেন, চাই ভারতের সঙ্গে আলোচনা, চাই বন্ধুত্ব। এর পর আরও এক ধাপ এগিয়ে ইমরান প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তাব দিলেন। মনে রাখতে হবে, ভোটের আগে থেকে পাক সেনাপ্রধান বার বার ভারতের সঙ্গে আলোচনা চেয়েছেন।
কূটনীতিতে মুখে বলা আর চিঠি দেওয়ার মধ্যে অনেক তফাত। ইমরানের চিঠি যে দিন এল, সে দিনই ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র সাংবাদিক বৈঠকে জানালেন, শীর্ষ স্তরে এখনই দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু না হলেও নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার ধারে দু’দেশের বিদেশমন্ত্রী বৈঠকে বসবেন। এই ঘোষণার আগের দিনও কাশ্মীরে পাক সীমান্ত ছিল অশান্ত। তবু ইমরানের চিঠিকে সমর্থন করে পাক সেনাবাহিনী বিবৃতি দেওয়ায় ভারতের মনে হয়, আলোচনার কৌশলই উপযুক্ত।
এর পরই কাশ্মীর সীমান্ত আরও অশান্ত হয়ে উঠল। ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যুর খবর এল। এল অপহরণের খবর। এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিদেশ মন্ত্রকের নাটকীয় ডিগবাজি— না, কোনও কথাই নয়। পাকিস্তান এক দিকে নৃশংস ভাবে সন্ত্রাস চালাবে আর অন্য দিকে আলোচনার জন্য মিথ্যে প্রস্তাব দেবে? এ চলতে পারে না। অতএব শীর্ষ বৈঠক তো দূরের কথা, বিদেশমন্ত্রক পর্যায়েও আর কোনও আলোচনা হবে না। এর পরই ইমরানের টুইট— মোদীর ঔদ্ধত্যের জন্যই কূটনৈতিক সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়ে গেল, এ হল দূরদর্শিতার অভাব। মোদী ইমরানের এই কথার কোনও জবাব দেননি।
যে দিন এই ডিগবাজি, সে দিনই দিল্লির মার্কিন দূতাবাসে এক রিসেপশন-এ প্রশ্ন উঠল, পাকিস্তান নিয়ে ভারতের ডিগবাজির রহস্য কী? যা শুনলাম তার মর্মার্থ— সিদ্ধান্ত বদলের পিছনে প্রধান কারণ হল, আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার। অজিত ডোভালের মাধ্যমেই এই কট্টর লাইন নিতে মোদীকে বাধ্য করা হল। প্রশ্ন করলাম, এত দিন তো শুনছিলাম, মোদীর কথাতেই আরএসএস চলে। এখন কি তা হলে উল্টো পরিস্থিতি? এক প্রবীণ সম্পাদক বললেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত ছিল সুষমা স্বরাজ ও বিদেশ সচিবের। আর কথা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হল, মোদী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার। প্রথম দিনের সিদ্ধান্তটা মোদী জানতেন না। আমি বললাম, এ-ও কি বিশ্বাসযোগ্য? এত দিন শুনেছি, কোনও মন্ত্রী বা সচিব মোদীকে না জানিয়ে এক গ্লাস জল পর্যন্ত খান না! আর, কাশ্মীরের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, সে কি হঠাৎ আজ হল? গত কাল, গত পরশু, তার আগেও তো পাক সন্ত্রাস অব্যাহত ছিল।
সুতরাং আপাতত এটুকু বলাই যায়, পাকিস্তান নিয়ে ভারতের নীতিতে গত পাঁচ বছরে এক চূড়ান্ত ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। এই ‘কভি খুশি কভি গম’ কূটনীতির মধ্যে কোনও কৌশল ও বৃহৎ দর্শন দেখছি না। দেখছি প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়া। যে সরকার নির্বাচনের আগে সার্জিকাল স্ট্রাইক দিবস গোটা দেশ জুড়ে রাজ্যে রাজ্যে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে সরকার এখন ইমরানের প্রস্তাবে সাড়া দিলে কি দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী ভোটব্যাঙ্কে আঘাত লাগবে? আর সেই কারণেই কি এমন কড়া সিদ্ধান্ত নিলেন ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’? তা হলে আলোচনার প্রস্তাবে কেন প্রথমে সাড়া দিয়েছিল বিদেশ মন্ত্রক?
পাঁচ বছর ধরে ডিগবাজি চলছেই। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শপথগ্রহণে সার্ক-এর সদস্য সমস্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ডাকেন। সবাই জানেন, নওয়াজ় শরিফই ছিলেন আসল লক্ষ্য। তার পরই হুরিয়ত নেতাদের দিল্লির পাক হাই কমিশনে ডাকার মতো তুচ্ছ ঘটনায় বিদেশ সচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল হল। আবার মোদী প্রথা ভেঙে নওয়াজ়ের বাড়ি চলে গেলেন কন্যার বিবাহ উপলক্ষে। কিন্তু কাশ্মীরে সন্ত্রাস বাড়তেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ভোটের আগে এখন শান্তি-শান্তি নয়, যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা বেশি জরুরি। অতএব তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা-নামার সেই অঙ্ক চলছেই।
মানছি, পাকিস্তানের রণকৌশল মোকাবিলা করা সহজ কাজ নয়। অতীতেও আমরা বার বার হাত পুড়িয়েছি। কিন্তু নিজের অবস্থানটা তো ঠিক রাখতে হবে! বাজপেয়ী তা পেরেছিলেন। তাঁর কূটনীতির দর্শন ছিল পরিষ্কার। মনমোহন সিংহের মতো তিনিও মনে করতেন, আলোচনাই একমাত্র পথ, এমনকি যুদ্ধ-পরিস্থিতিতেও। লাহৌর বাসযাত্রার সময় বাজপেয়ীর সঙ্গে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। মনে আছে, লাহৌরে নওয়াজ় যতই মৈত্রীর কথা বলুন, তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ় মুশারফ যে খুশি নন, তা তখনই বাজপেয়ী জানতে পারেন। হেলিপ্যাডে তিন পাক সেনাপ্রধান তাঁকে স্বাগত জানাতে আসেননি। কিন্তু তাতেও তিনি বিচলিত হননি। নওয়াজ়কে পাশে নিয়ে মৈত্রীর লক্ষ্যে অতিরিক্ত পথ হাঁটতে দ্বিধা করেননি। নওয়াজ়ের সমস্যার কথাটাও তিনি বুঝতেন। একটা ঘটনার কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাজপেয়ীর প্রথম বিদেশ সফর ছিল কলম্বোয় সার্ক সম্মেলন। সেখানে নওয়াজ়-বাজপেয়ীর প্রথম বৈঠকের পর দু’টি সাংবাদিক বৈঠক হয়। টেবিলে ভারতের জাতীয় পতাকা রেখে বাজপেয়ী বলেন, বৈঠক সফল, আলোচনার পথে হাঁটব। তার পর ওই পতাকাটি সরিয়ে পাক জাতীয় পতাকা রেখে নওয়াজ় বললেন: বৈঠক বিগ জ়িরো। কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ না হলে কিসের আলোচনা?
সাংবাদিক বৈঠকে বাজপেয়ীর মিডিয়া উপদেষ্টা অশোক টন্ডন বলে উঠলেন, কী অদ্ভুত! এত ক্ষণ বৈঠকে কত ভাল কথা বললেন, এমনকি দু’দেশের বাণিজ্যের কথা হল, এখন এ সব বলছেন? বাজপেয়ী শুনে বললেন, ওকে তো এ সব বলতেই হবে। তা না হলে সেনাবাহিনী খেপে যাবে তো! এটাই ছিল বাজপেয়ীর বৈশিষ্ট্য। কলম্বোর পর সেপ্টেম্বরে বাজপেয়ী-নওয়াজ় বৈঠক হল নিউ ইয়র্কে। ঘোষিত হল লাহৌর বাসযাত্রা। আবার, যে পারভেজ় মুশারফ কার্গিল যুদ্ধের কারিগর, দু’বছর পরে আডবাণী-জর্জ ফার্নান্ডেজ় আর সঙ্ঘের আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাজপেয়ী আগরায় শীর্ষ বৈঠক করলেন তাঁর সঙ্গে। আগরা ব্যর্থ হলেও ইসলামাবাদ গিয়ে যৌথ বিবৃতি দিলেন। শান্তি আলোচনার অগ্রাধিকারকে কখনও বিসর্জন দেননি।
এখন ইমরানের পাকিস্তান সম্পর্কে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্র মানে শুধুই সেনা, ইমরান তাঁদের হাতের পুতুল। জেহাদিরাও সেনা নিয়ন্ত্রণে। পাক বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাক সেনাবাহিনী নাকি ভিতরে ভিতরে জেহাদি-নির্ভরতা কমাতে চাইছে। সেটা কতটা সত্যি, বলা কঠিন। কিন্তু কূটনীতির দাবি মানতে হলে, এক দিকে যেমন পাক সন্ত্রাস মোকাবিলা করতে হবে দ্ব্যর্থহীন ভাবে, অন্য দিকে আলোচনা বন্ধ করে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না।
নরেন্দ্র মোদী এখন অর্জুন, তাঁর চোখে শুধুই ২০১৯। ভোট বড় বালাই মানছি, কিন্তু আলোচনার পথ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প রেডিমেড সমাধান যে নেই, এই সহজ সত্য বোঝাটাই রাজধর্ম।