Advertisement
১১ মে ২০২৪

ফেলে আসা শৈশব চিরদিনই রঙিন, অমলিন

বাগানের এক প্রান্তে ছিল আমাদের খেলার সঙ্গী, পোষা কুকুর  ‘হোবো’র কবর। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে সেই কবরে একটা টগর ফুল রেখে আসতাম। লিখছেন হিমি মিত্র রায়বাগানের এক প্রান্তে ছিল আমাদের খেলার সঙ্গী, পোষা কুকুর  ‘হোবো’র কবর। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে সেই কবরে একটা টগর ফুল রেখে আসতাম। লিখছেন হিমি মিত্র রায়

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৮
Share: Save:

বাবা-মায়ের কাছে এসে এ বার ক’দিন ছিলাম। প্রতিদিন দুপুরে আমাদের বাড়ির ছাদে উঠেছি। প্রথম দিন এমনিই উঠেছিলাম। পরের দিনগুলোতে একটা অদ্ভুত টানে উঠেছি। ছাদ থেকে আমাদের কাকা, জেঠুদের বাড়িগুলো দেখা যায়। বাড়ির উঠোন ঘিরে বসতি। কত স্মৃতি জড়িত এই উঠোন নিয়ে। উঠোনের ঘাস, মাটিতে জড়িয়ে আছে আমাদের কত কত স্মৃতি। শুধু ঘরগুলোয় এখন মানুষ থাকে হাতেগোনা। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে। জেঠুরাও সকলে নেই। বাড়িগুলো দেখলে মনে হয়, সব ধ্বংসের অপেক্ষায় একটা একটা করে দিন গুনছে।

সকলে মিলে লুকোচুরি, রংমামা, কুমিরডাঙার মতো কত কিছু খেলতাম। সে সব নাম বলে শেষ করা যাবে না। সারা বাড়ির অলিগলি ঘুরে বেড়াতাম। তখন আমাদের উপর অভিভাবকদের এত তীক্ষ্ণ নজরদারি ছিল না। স্কুলে পাঠানোর আগে আমাদের কেউ বলত না, ‘‘অমুকের কাছে একা যাবে না। তমুকদের কোলে বসবে না। স্কুলে কেউ খারাপ ভাবে গায়ে হাত দিলে বাড়িতে বলবে।’’

ভ্যানকাকু নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে স্কুলে নিয়ে যেত। আবার স্কুল ছুটি হলে আমাদের পৌঁছে দিত বাড়িতে। তার পরে কোনও রকমে নাকে-মুখে গুঁজে ছুটতাম মাঠে। পাড়ার বন্ধুরা জুটতাম সেখানে আর খেলতে খেলতে কখন যে সন্ধে নেমে আসত টের পেতাম না। রোজ কারও না কারও মা এসে তার মেয়ের বা ছেলের কান মুলে দিত। তার পরে গুটিগুটি পায়ে আমরাও চলে আসতাম যে যার বাড়ির দিকে। এখন সে সব অতীত। ওই ছোট মাঠে কত্ত অনুষ্ঠান করেছি। নাটক থেকে শুরু করে নাচ, গান, আবৃত্তি কত কী!

এক চিলতে মাঠ এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বাচ্চাদের আগে ডেকে ঘরে ঢোকানো যেত না। আর এখন মোবাইল আর টিভির সৌজন্যে তাদের মাঠ না থাকলেও চলে যাচ্ছে। টিভিতে ডোরেমন, ছোটা ভীমেরাই তাদের বন্ধু। মাঠেঘাটে খেলার সময় কান ধরে বাড়িতে দিয়ে যাওয়ার অমুক কাকু, তমুক জেঠুরাও আর নেই। চিলতে উঠোন বিলুপ্তির পথে। চারপাশে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে শুধুই ফ্ল্যাটবাড়ি। ভয় হয় এই ভেবে যে, সাকুল্যে বেঁচে থাকা আমাদের বাড়ির মতো আর দু’একটা বাড়িরও ভবিষ্যৎও কি তবে এমনটাই!

জামার কোলে জংলি পাতা, ঢেকির শাক তুলে আমাদের বাড়ির বাগানে মিছিমিছি রাঁধতাম কত পদ! বাগানের এক প্রান্তে ছিল ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, আমাদের পোষা কুকুর ‘হোবো’র কবর। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে ওর কবরে একটা টগর ফুল রেখে আসতাম। বলতাম, হোবো তুই শান্তিতে ঘুমো! হোবোর কবরের উপর এখন বাড়ি উঠেছে। পাশের গন্ধরাজ লেবুগাছটাও নেই। কাটা পড়েছে কাঁচামিঠে আম গাছ, জলপাই। এখন শুধুই কংক্রিটের ঠোকাঠুকি। প্রতি বার আসি আর দেখি, একটা একটা করে জায়গা চলে যাচ্ছে প্রোমোটারদের হাতে। দেখি, চারদিকে ধুলোর ঝড়, শপিং মলের হাতছানি, মার্কেট কমপ্লেক্স আর মোটরবাইবাইক রেস। রাস্তা দিয়ে চলা মানে প্রাণ হাতে নিয়ে চলা।

গরমের ছুটিতে বা পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি যাওয়া ছিল একটা রুটিনের মতো। কবে ওই দিন আসবে তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। মাসি, মামা, দিদি, বোন, ভাই, দিদুন, দাদু— সব মিলিয়ে গমগম করত মামাবাড়ি। মামাবাড়ির বোধহয় একটা আলাদা গন্ধ হয়। ভারী মিষ্টি। ওখানে বকা, রাগারাগির কোন স্থান ছিল না। শুধুই আনন্দ, হাসি, গান, আর মজা। আম, কাঁঠাল, আমলকি, পেয়ারা আরও কত সব ফুল গাছ! বেড়া দেওয়া সামনের গেটের বাইরে ছিল একটা কামিনী ফুলের গাছ। সন্ধেবেলা ওই গাছের তলা দিয়ে যাওয়া বারণ ছিল। শুনতাম, এই ফুলের গন্ধে নাকি সাপ আসে! যদিও আমরা কখনও সেখানে সাপ দেখিনি। এত মিষ্টি গন্ধ যে সামনে যেতে বারবার আমাদের যেতে ইচ্ছে করত। দিদুন আমাদের সব ভাইবোনেদের নিয়ে গরমের সন্ধেয় বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসত। সেখানে বসে আচারের তেল, চানাচুর, পেঁয়াজ আর ধনেপাতা দিয়ে মাখানো মুড়ির স্বাদ আজও জিভে লেগে রয়েছে। হরেক কিসিমের গপ্পে গপ্পে কখন যে এক থালা মুড়ি উধাও হয়ে যেত বোঝা যেত না।

থ্রি বা ফোরে পড়ার সময় দলবেঁধে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম এবং সেই শেষ। আমরা, ছোটরা সামনে বসেছিলাম। উফ, কী যে আনন্দ হয়েছিল! রাতে যাত্রা দেখে ভোরে ঘুমঘুম চোখে বাড়ি ফিরেছিলাম। পরের দিন ঘুম ভেঙেছিল দুপুরে।

বিকেলে রোজই যেতাম সামনের পার্কে। মা, মাসিরাও আমাদের সঙ্গে দোলনায় উঠত। তা দেখে আমরা হাসতাম! ভাগ্যিস তখন মোবাইলে ছবি বা সেল্‌ফি তোলা ছিল না! নইলে আমাদের সেই অনাবিল আনন্দ গৌণ হত, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করাটাই হত মুখ্য।

টুকরো টুকরো এমন অজস্র ছবি মনের হার্ড ডিস্কে জমা হয়ে রয়েছে। যা কেউ কোনও দিন ‘ডিলিট’ করতে পারবে না! সময়ের উপরে সময়ের প্রলেপ পড়তে পড়তে কত কিছু ফিকে হয়ে যায়, হারিয়ে যায়। কিন্তু শৈশব থেকে যায় রঙিন, অমলিন। চিরদিন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Memory Childhood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE