Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়, প্রশ্নটা আদৌ সহজ নয়

মুখ দেখে লোক চেনেন?

‘‘আসতে না আসতেই আরম্ভ হয়ে গেল। আগে বলুন, পিঠের ব্যথাটা কেমন?’’ কথা কাটে তপেশ।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

মাস দুয়েক পর গোপালের দোকানে ঢুকলেন শিবুদা। ঢুকতে ঢুকতেই কানে গিয়েছে শিশিরের কথার শেষটুকু— ‘‘দেখে তো লোকটাকে বেশ ভরসা করার মতোই মনে হল।’’ ‘‘দেখেই লোক চেনার মতো মাতব্বর হয়ে গিয়েছিস তবে?’’ বসতে বসতে প্রশ্ন ছুড়েন শিবুদা।

‘‘আসতে না আসতেই আরম্ভ হয়ে গেল। আগে বলুন, পিঠের ব্যথাটা কেমন?’’ কথা কাটে তপেশ।

‘‘দু’মাস চিৎ করে ফেলেছিল, বুঝতেই পারছিস’’, উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘কিন্তু, আসল কথাটা এড়িয়ে যাসনে। একটা লোককে শুধু দেখে তার ভাল-মন্দ বুঝিস কী করে? শিশির, বল।’’

‘‘এটা একটা কথা হল? ইনটিউশন বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, না কি?’’ শিশির উত্তর দেয়। ‘‘এক এক জনকে দেখলেই আপনার মনে হয় না যে লোকটা পাজি? সে দিন পড়ছিলাম, মানুষ নাকি প্রথম সাক্ষাতের পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই উল্টো দিকের লোকটা সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করে ফেলে।’’

‘‘পনেরো সেকেন্ড কি না, জানি না, তবে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যে লোকে অন্যের সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করে, সেটা অস্বীকার করি না। তবে, ভুল করে। নিজের অজান্তেই ভুলটা করে, কিন্তু তাতে যে কতখানি ক্ষতি হতে পারে... ও গোপাল, চা দিতেও ভুলে গেলি নাকি?’’ শিবুদা হাঁক পাড়েন। গোপাল কাপ টেবিলে নামিয়ে গেল। চুমুক দেন শিবুদা। শিশিরের প্যাকেটটা টেনে একটা সিগারেট ধরান।

‘‘সোজা কথা হল, মুখ দেখেই কে কেমন লোক তা বুঝতে পারার জন্য যত লোককে তোর চেনা দরকার, তুই তার কণামাত্রও চিনিস না। শুধু তুই নোস, আমরা কেউই চিনি না। আমাদের স্যাম্পল সাইজ় অতি ছোট— সেটা থেকে কিছু বোঝার মতো তথ্য পাওয়া অসম্ভব। তবু আমরা সেটাই করি। কী ভাবে করি, জানিস?’’ শিবুদা থামলেন।

‘‘হিউরিস্টিকস’’, উত্তর দেয় সূর্য।

‘‘শাবাশ!’’ শিবুদার প্রশংসা। ‘‘বাকিটা বল।’’

‘‘আপনার ড্যানিয়েল কানেম্যানের বই পড়েই জেনেছি, শিবুদা’’, সূর্য ইতস্তত করে। তার পর বলে, ‘‘সাদা বাংলায়, যে কোনও কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তার সঙ্গে জড়িত কোনও সহজ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, আর সেই উত্তরকেই সেই কঠিন প্রশ্নের উত্তর বলে চালিয়ে দেওয়া। গোটাটাই অবচেতনে। ধরুন, চার বছরের তুলনায় এখন ইনফ্লেশন কতটা বেশি, এই প্রশ্নের উত্তরে আমার মন আজকের বাজারে পটলের দরের কথা ভাববে। কারণ, মূল্যস্ফীতির হারের হিসেব জানি না, কিন্তু আজ যে হেতু বাজারে গিয়েছিলাম, তাই পটলের দর জানি।’’

‘‘ঠিক। অনেক রকম হিউরিস্টিকস হয়, তার মধ্যে ‘অ্যাভেলেবিলিটি হিউরিস্টিকস’-এর কথা বলি’’ শিবুদা খেই ধরে নিলেন কথার। ‘‘যত কম কষ্টে উদাহরণ মনে আসে, ততই কোনও ঘটনাকে বেশি সম্ভাব্য মনে হয়। ধর দু’জন লোককে দুটো আলাদা প্রশ্নপত্র দেওয়া হল। প্রত্যেকটাতে দুটো প্রশ্ন। প্রথম জনের প্রশ্ন দুটো হল: তিনটে সবুজ রঙের জিনিসের কথা বলুন; যে কোনও একটা ঘরে ঢুকে কোনও সবুজ জিনিস দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কত শতাংশ? দ্বিতীয় জনের প্রশ্নপত্রও প্রায় এক, শুধু তিনটের বদলে দশটা সবুজ জিনিসের কথা উল্লেখ করতে বলা হল। প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, দ্বিতীয় লোকটির মতে সবুজ জিনিস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রথম লোকের তুলনায় কম হবে। কারণ, তিনটের তুলনায় দশটা সবুজ জিনিসের কথা মনে করতে কষ্ট অনেক বেশি। আর, যেটা মনে পড়তে যত কষ্ট, আমাদের মনে হয়, সেটা ততই অসম্ভব।’’

‘‘একটা বুদ্ধি দিই, শোন’’, শিশিরকে বলে তপেশ। ‘‘আজ বাড়ি গিয়ে বৌকে বলবি, আমার বারোটা দোষের কথা বলো। কর গুণে গুণে বারোটা বলার পর জিজ্ঞেস করবি, এ বার বলো, আমি কতটা খারাপ লোক? দেখবি, বৌ থতমত খাবে।’

‘‘আবার আমার বৌ নিয়ে টানাটানি কেন?’’ শিশির ছদ্ম আপত্তি করে।

‘‘শিশিরের বৌকে ছাড়, তপেশ। তবে, কথাটা ঠিক বলেছিস’’, তপেশের পিঠ চাপড়ে দেন শিবুদা। ‘‘বরং শিশিরের লোক চেনার গল্পে চলে যাই। কোনও এক জনকে এক ঝলক দেখেই ভাল লাগে বা মন্দ লাগে, কেন? তার কারণ, যে কোনও অপরিচিত লোককে দেখলে তার থেকে বিপদের আশঙ্কার হিসেব কষা মনের আদিমতম প্রবৃত্তি। লোকটার চেহারার যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের চোখে ঠেকে, সেগুলো থেকেই মন উত্তর খোঁজে। কী ভাবে? চওড়া শক্ত চোয়াল, টিকলো নাক— এ রকম চেহারার ক’জন ভাল লোককে চিনি? এখানেই হিউরিস্টিকস, কঠিন প্রশ্নের বদলে সহজ প্রশ্ন। যত দ্রুত কয়েক জনের কথা মনে পড়ে, এই বৈশিষ্ট্যওয়ালা অচেনা লোককে ভাল বলে ঠাহরাতেও তত সুবিধা।’’ একটানা কথাগুলো বলে থামেন শিবুদা।

‘‘আমার মন এতগুলো হিসেব কষে, আর আমি জানতেও পারি না?’’ শিশির প্রশ্ন করে।

‘‘এত দিন ধরে যে এত জ্ঞান দিলুম, তাতেও বুঝলি না যে তোর মনের কথা মনও জানে না?’’ শিবুদা মুচকি হেসে উত্তর দেন। তার পর উঠে পড়েন।

‘‘চলে যাচ্ছেন না কি?’’ বাধা দেয় সূর্য। শিবুদা পিঠ টান করেন, সামনে-পিছনে ঝোঁকেন। বলেন, ‘‘একটানা বসে থাকতে পারছি না।’’

‘‘শিশির এর পর কারও পিঠে ব্যথা দেখলেই ভাববে সেও আপনার মতো জ্ঞানী!’’ চিমটি কাটার সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ তপেশ।

শিবুদা বসলেন। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে তপেশের টিপ্পনি উড়িয়ে বললেন, ‘‘বাজে বকিস না, শোন। মন আসলে গল্প বানানোর মেশিন। তার কারণ আছে— অভিজ্ঞতার সুতোয় বর্তমানের কয়েকটা ঘটনাকে গেঁথে একটা গল্প বানাতে পারি বলেই আমরা চলেফিরে বেড়াই। ১৯৮০ আর ১৯৯০-এর দশকে বিস্তর গবেষণা হয়েছে মনের এই গল্প বানানোর ক্ষমতা নিয়ে। দেখা গিয়েছে, বাচ্চারও এই ক্ষমতা থাকে। কিন্তু মুশকিল হল, যেখানে কোনও গল্প নেই, মন সেখানেও গল্প বানায়। যেখানে প্যাটার্ন নেই, সেখানেও প্যাটার্ন খোঁজে। হাতের কাছে— বা, বলা ভাল, মনের কাছে— যতটুকু তথ্য থাকে, তা দিয়েই গল্প খাড়া করতে চায়।’’

‘‘নাসিম তালেব খাসা উদাহরণ দিয়েছিলেন’’, সূর্য বলে। ‘‘যে দিন সাদ্দাম হুসেনকে ধরল মার্কিন সেনা, সে দিন সকালে লগ্নিকারীরা শেয়ারের বদলে মার্কিন ট্রেজ়ারি বন্ডে টাকা ঢালছিলেন। ব্লুমবার্গ নিউজ় সার্ভিস নিউজ়ফিড পাঠাল, ‘লগ্নিকারীরা ভরসা পাচ্ছেন না: সাদ্দামকে ধরার পরও সম্ভবত সন্ত্রাসবাদ কমবে না’। খানিক ক্ষণ বাদেই ট্রেজ়ারি বন্ডের দাম পড়ল, ইক্যুইটিতে লগ্নি বাড়ল। সেই ব্লুমবার্গই ফের নিউজ়ফিড পাঠাল, ‘সাদ্দাম গ্রেফতার হওয়াতে ঝুঁকিপূর্ণ লগ্নির দিকে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা’! সে দিন সবচেয়ে বড় খবর ছিল সাদ্দামের ধরা পড়া। ফলে, শেয়ার বাজারের সঙ্গেও তার সম্পর্কের গল্প খাড়া করে দেওয়া গিয়েছিল।’’

‘‘দ্য ব্ল্যাক সোয়ান-এ পড়েছিস তো?’’ শিবুদা প্রশ্ন করেন। তার পর বললেন, ‘‘এ বার একটা প্রশ্ন করি, দেখ তো উত্তর দিতে পারিস কি না। ধর, শ্রুতি নামে একটি মেয়ে আছেন, যাঁর বয়স এখন ৩০ বছর। অর্থনীতির ছাত্রী ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বামপন্থী রাজনীতি করতেন, সমকামী অধিকারে বিশ্বাসী, হিন্দুত্ববাদ বিরোধী, কাশ্মীরে মিলিটারির দাপাদাপিতে প্রবল ক্ষুব্ধ, মুসলমান বয়ফ্রেন্ড ছিল। এ বার বল দেখি, তিনটে পরিচিতির মধ্যে শ্রুতির কোন পরিচিতির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি— এক, শ্রুতি ইউনিভার্সিটিতে পড়ান; দুই, শ্রুতি মুদিখানা চালান; তিন, শ্রুতি ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, পাশাপাশি নারীবাদী আন্দোলনেও সক্রিয় ভাবে যুক্ত। কোনটা সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য, আর কোনটা সবচেয়ে কম?’’

‘‘জেএনইউ-র মেয়ে, নো ডাউট। তিন নম্বরটা হবে— ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, পাশাপাশি নারীবাদী আন্দোলনের কর্মী। তাই তো?’’ প্রশ্ন করে তপেশ।

শিবুদা শিশির আর সূর্যর দিকে তাকান। শিশির তপেশের কথার তালে মাথা নাড়ে।

‘‘নিজেদের কাণ্ডটাই দেখ’’, শিবুদা বলতে থাকেন, ‘‘এখনকার শ্রুতির পরিচিতি কী হতে পারে, সেই কঠিন প্রশ্নটাকে বদলে প্রথমে তোরা একটা সহজ প্রশ্ন বেছে নিলি— এ রকম যে মেয়েগুলোকে আমরা চিনি, তাঁরা কী করেন? মুদিখানা চালান, সেটা নিতান্ত অসম্ভব ঠেকল। বাদ দিয়ে দিলি। পড়ে থাকল দুটো সম্ভাবনা। শুধু ইউনিভার্সিটিতে পড়ান? মন খচখচ করল। নারীবাদী আন্দোলনটা জুড়ে নিয়ে শান্তি— পরিচিত ছকে পড়ে গেল। এ বার ভেবে দেখ, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তোর মন কত কিছু করল। শ্রুতির সম্বন্ধে কয়েকটা তথ্য থেকে তাঁর একটা প্রোফাইল খাড়া করে ফেলল। যে তথ্য আমি দিইনি, সেটাও নিজে থেকে জুড়ে ফেলল— আমি কিন্তু এক বারও বলিনি শ্রুতি নারীবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তার পর, সেই ধরে নেওয়াটাকে চাপিয়ে দিলি স্ট্যাটিস্টিকস-এর ঘাড়ে। ভাব, গোটা দুনিয়ায় যত নারীবাদী অধ্যাপক আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু ‘অধ্যাপক’। অর্থাৎ, ‘ইউনিভার্সিটিতে পড়ান’— এই সম্ভাবনার মধ্যে সব নারীবাদী অধ্যাপক আছেন, যাঁরা নারীবাদী নন, তাঁদের সঙ্গেই। তোদের কিন্তু সেই কথাটা মনে পড়ল না।’’

তপেশ আর শিশির অধোবদন। শিবুদা বলে চললেন, ‘‘আরও মুশকিল হল, মাথায় যে কোন ছবিটা থাকবে, সেটা পুরোপুরি তোর হাতে নয়। মাথায় ছবি পুরে দেওয়া যায়। ধর, ফেজ টুপি আর দাড়ির সঙ্গেই যদি কারও মাথায় সন্ত্রাসবাদীর ছবি ঢুকিয়ে দেয় কেউ? মহিলা মানেই দুর্বল, সিদ্ধান্ত করার ক্ষমতাহীন, এমন একটা কথা যদি মনে গেঁথে থাকে? অথবা, চওড়া ছাতি আর চওড়া কব্জি মানেই তার ওপর ভরসা করা যায়, এই কথা যদি অবচেতনে আস্তানা গাড়ে? লোক চিনতে ভুল হবে না তখন?’’

শিবুদা উঠে পড়েন। কোমরটা সোজা করতে করতে বলেন, ‘‘যত লোককে চিনলে তবে লোক চেনা যায়, তত লোককে কখনও চিনে উঠতে পারবি না, এই কথাটা মনে রাখিস, কেমন?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mind Intuition Hysterics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE