E-Paper

গুরুত্বহীন

বিজেপি জমানাতেই কয়েক বছর আগে অবধি যে আধার রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য নাগরিকের কাছে আবশ্যিক ছিল, এখন বিজেপি নেতারাই জানাচ্ছেন যে, তা নিতান্তই বাহুল্য।

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৫ ০৫:১০

কিছু দিন আগে অবধিও দেশবাসী জানতেন, আধার বিনা জগৎ মিথ্যা। সরকারি প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করার জন্য তো বটেই, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে মোবাইল ফোনের নতুন সিম নেওয়া, এমনকি সন্তানের স্কুলে ভর্তির সময়ও আধার কার্ড বিনা গতি ছিল না। ফলে, মানুষ বাধ্য হয়ে পুরনো কথা ভুললেন— ইউপিএ সরকারের আমলে নন্দন নিলেকানির নেতৃত্বে যখন আধার প্রকল্পের কাজ আরম্ভ হয়েছিল, তখন খুব স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছিল যে, আধার আবশ্যিক নয়, ঐচ্ছিক পরিচয়পত্র। কিন্তু, সরকারই যে-হেতু ‘মাই-বাপ’, ফলে দেশবাসী বুঝলেন, আধার না করালেই নয়। সম্প্রতি ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা গেল, আধারের আদৌ কোনও গুরুত্ব নেই। তা নিছকই ‘আর একটি পরিচয়পত্র’— বিজেপি নেতারা জন প্রতিনিধিত্ব আইন এবং নাগরিকত্ব আইনের উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, আধারকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করলে মহাভারত থেকে সংবিধান, সবই অশুদ্ধ হবে। অসমে হিমন্তবিশ্ব শর্মা জানিয়েছেন, প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের জন্য নতুন আধার দেওয়া তাঁরা বন্ধ করছেন, কারণ তাতে নাকি মূলত অনুপ্রবেশকারীরাই আধার কার্ড পাচ্ছেন। বিহারের উদাহরণ পেশ করে বিজেপি আইটি সেলের কর্তা অমিত মালবীয় দাবি করেছেন, সে রাজ্যে নিবিড় সংশোধনের মাধ্যমে বাতিল হওয়া ৬৫ লক্ষেরও বেশি ভোটারের মধ্যে মাত্র দেড় শতাংশ ফের নাম নথিভুক্ত করার আবেদন জানিয়েছেন। অস্যার্থ, বাকি সাড়ে ৯৮ শতাংশের কাছে যদি আধার কার্ড থাকেও, তবুও তাঁরা হয় মৃত, নয় বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা। অর্থাৎ, এই বিজেপি জমানাতেই কয়েক বছর আগে অবধি যে আধার রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য নাগরিকের কাছে আবশ্যিক ছিল, এখন বিজেপি নেতারাই জানাচ্ছেন যে, তা নিতান্তই বাহুল্য।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, ফলে নাগরিককে মেনে নিতে হবে আধারের এই গুরুত্বহানি। কিন্তু, একটি প্রশ্ন করা প্রয়োজন: যে ব্যবস্থাটির কোনও গুরুত্ব সরকারের কাছে নেই, এত দিন কেন নাগরিককে বাধ্য করা হল তার অংশীদার হতে? দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট যে, আধারের অপব্যবহার ঠেকানোর কোনও পন্থা তাঁদের জানা নেই— বস্তুত, জানার চেষ্টাও নেই। তা হলে কেন নাগরিককে বাধ্য করা হল বায়োমেট্রিক-সহ তাঁদের সমস্ত তথ্য সরকারের কাছে জমা করতে? কেনই বা প্যান কার্ড থেকে ফোন নম্বর, সব কিছু সংযুক্ত হল আধারের সঙ্গে? ইতিমধ্যেই একাধিক বার আধারের তথ্য চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বস্তুত আজকের যুগে, যখন তথ্যকেই নতুন পেট্রলিয়াম বলে গণ্য করা হয়, তখন ভারতের একশো পঁয়তাল্লিশ কোটি নাগরিকের এই তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হল কোন উদ্দেশ্যে, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই।

বহু বার অভিযোগ উঠেছে যে, আধারের মাধ্যমে নাগরিকের সমস্ত তথ্য রাষ্ট্রের হাতের মুঠোয় আনার প্রধানতম উদ্দেশ্য হল নাগরিকের উপরে নিরন্তর নজরদারির ব্যবস্থা করা। একটি পুলিশ-রাষ্ট্র নাগরিককে সর্বদা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রাখার এই সুযোগ হাতছাড়া করবে না। প্রশ্ন হল, শাসকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনই কি গণতন্ত্রে যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র হতে পারে? ভারতবাসী নোট বাতিলের সময় দেখেছেন, কী ভাবে কার্যত প্রতি দিন পাল্টে যেত অর্থব্যবস্থার কোমর ভেঙে দেওয়া এই সিদ্ধান্তের ‘ঘোষিত উদ্দেশ্য’। পরের সাড়ে আট বছর প্রমাণ করেছে যে, সেই উদ্দেশ্যগুলির কোনওটিই সাধিত হয়নি। কিন্তু, হয়তো কাকতালীয় ভাবেই, ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। আধারের জন্য তথ্য সংগ্রহে অত্যুৎসাহ, তার পর আধার প্রায় সর্বজনীন হয়ে উঠলে তাকে কার্যত অবান্তর ঘোষণা করে দেওয়া— এর মধ্যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে কি না, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Citizenship

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy