মার্গদর্শন একটি জরুরি কাজ। তবে তার আগে কোন মার্গ শ্রেয়, তা নির্ধারণ করাও জরুরি। একটি নির্দিষ্ট বয়সকে মান্য করে বর্ষীয়ান নেতাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য পথ ছেড়ে দেওয়া— এই মার্গটি কত গুরুত্বপূর্ণ? সকলের জন্যই কি সমান গুরুত্বপূর্ণ? এমনকি এগারো বছরের বিজয়নিষিক্ত প্রধানমন্ত্রীর জন্যও কি তাই? ইত্যাকার কঠিন সমস্যায় এই মুহূর্তে জর্জরিত ভারতীয় হিন্দুত্ব রাজনীতির অন্তঃপুর। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত দুই জনেই পঁচাত্তর বছরে পা দিচ্ছেন সেপ্টেম্বরে। আরএসএস রীতিতে, পঁচাত্তরই হল রাজনৈতিক সন্ন্যাসে যাওয়ার বয়স— প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবন ছেড়ে দিয়ে মার্গদর্শকমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার সময়। এই দুই ব্যক্তির দ্বিতীয় জন সরে যাবেন সেপ্টেম্বরেই, পরবর্তী সঙ্ঘচালক সন্ধান প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই চলমান। প্রশ্ন প্রথম জনকে নিয়ে। আরএসএস সদস্য হিসাবেই এক দিন তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল, কিন্তু সঙ্ঘের নীতি অনুসরণ করে তিনি আদৌ সরবেন কি না, নাগপুর থেকে দিল্লি এ বিষয়ে কূজন-গুঞ্জনে মুখরিত। সম্প্রতি সেই গুঞ্জন জোরালো রব নিল যখন সরসঙ্ঘচালক ভাগবত একটি অনুষ্ঠানে আবারও পঁচাত্তর বছর বয়স মানে ‘থেমে যাওয়া’র ও অন্য কাউকে ‘জায়গা ছেড়ে দেওয়া’র সময় বলে অভিহিত করলেন।দেশব্যাপী শ্রোতাদের কানে যেন তা ঠেকল একটি ‘বার্তা’র মতো। বিরোধী নেতৃবৃন্দ সঙ্গে সঙ্গে বল লুফে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরে যাওয়ার ঔচিত্য নিয়ে নানা আলোচনায় প্রবৃত্ত হলেন। সঙ্ঘীয় রীতিটি যে অধিকাংশ নেতার ক্ষেত্রেই, এমনকি মুরলীমনোহর জোশী ও লালকৃষ্ণ আডবাণীর জন্যও প্রযুক্ত হয়েছে, সেই দৃষ্টান্ত উঠে আসছে।
সংশয় নেই, অনেক গুঞ্জনের মতোই এটিও সম্ভবত ভিত্তিহীন। প্রধানমন্ত্রীর তথাকথিত ‘সাফল্যগৌরব’-এ বিজেপি— এবং আরএসএস-ও— যে পরিমাণ ভাসমান ও নির্ভরশীল, তাতে মধ্যপথে তাঁর অবসর গ্রহণের প্রশ্নটি অ-ভাবনীয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনেক দিন আগেই সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এমনকি আরএসএস-এর বিভিন্ন মুখপাত্রও সতর্ক করেছেন যে সরসঙ্ঘচালক ভাগবতের কথার অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা না খুঁজতে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সেখানে কোনও ইঙ্গিত নেই। এও ঠিক যে, ইতিমধ্যে বিজেপির কতিপয় নেতা এই রীতির ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মূল প্রশ্নটি অবশ্য কোনও ব্যক্তি নিয়ে নয়, এমনকি নীতি নিয়েও নয়, বরং সম্পর্ক নিয়ে। আরএসএস এবং বিজেপির মধ্যে আদৌ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে কি না, থাকলে তা কতখানি, এ সব বহু দিন ধরেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চর্চার বিষয়। মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক মন্তব্যে সেই চর্চা আরও খানিক ইন্ধন পেল— তা-ও আবার সঙ্ঘের শতবর্ষ পূর্তির মহাক্ষণে: প্রকৃত সংবাদ এটিই।
সাধারণত দেখা গিয়েছে, মোহন ভাগবতের কোনও মন্তব্যই আলটপকা নয়, বরং সতর্ক বিবেচিত। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বিজেপির তুলনায় মন্দ ফলের প্রেক্ষিতে তিনি ‘শাসকের স্পর্ধা’র উল্লেখ করেছিলেন, এবং সত্যকারের সঙ্ঘসেবকরা যে স্পর্ধা দেখান না, তা-ও বলেছিলেন। বাস্তবিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকতার মধ্যে সংঘাত কোনও নতুন বিষয় নয়। প্রায় সমস্ত আদর্শতান্ত্রিক রাজনীতিতেই কখনও না কখনও এই সংঘাত পরিস্ফুট হয়েছে। আবার, প্রবীণের অভিজ্ঞতা বনাম নবীনের তারুণ্যশক্তি, এই সংঘাত কেবল আদর্শতান্ত্রিক রাজনীতি কেন, কংগ্রেস-সহ সব দল ও গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতাতেই বিদ্যমান। কী ভাবে এই সব ‘সংঘাত’-এর সমাধান হচ্ছে, একশো বছরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ তার সর্ব কালের সেরা শক্তিমান রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তি-ইমেজ’এর সঙ্গে কী ভাবে মোকাবিলা করছে— তার উপরই নির্ভর করবে হিন্দুত্ব রাজনীতির পরবর্তী যাত্রা-অভিমুখ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)