E-Paper

বিদ্বেষ-প্রকল্প

এমন ভাবে যেন যুদ্ধ, রাজ্যজয়, হিংসা ছাড়া ওই আমলে আর কিছু ঘটেনি, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ও উৎকর্ষও না।

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:০৭
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

দলীয় রাজনীতির মূল কথাটাই হল রাজনৈতিক মতাদর্শ, প্রচারিত বয়ানের ভিন্নতা। গণতন্ত্রে এ জিনিস সবাই মেনে নেন এই বিশ্বাসে যে, নাগরিক নিজস্ব বিচার-বিবেচনায় সেই বয়ান মানবেন, বা মানবেন না। কিন্তু যারা ঊন-নাগরিক বা সরলমতি অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদেরও যখন রাজনীতি গ্রাস করতে চায়, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় আতঙ্কের ও আশঙ্কার— কারণ তাদের এখনও বিচারবুদ্ধি হয়নি, তাদের যা বেশি করে বলা বা দেখানো হবে তারা তা-ই বিশ্বাস করবে। এখনকার ভারতে ঠিক এটাই হয়ে চলেছে— স্কুল স্তরের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবই, বিশেষত ইতিহাস বইয়ে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে।

এনসিইআরটি-র যে বইগুলি দেশ জুড়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বহুপঠিত ও স্বীকৃত, সাম্প্রতিক কালে তাদের বিরুদ্ধেই গুরুতর অভিযোগ উঠেছে— মোগল ও সুলতানি আমল এই বইগুলিতে শুধুই ইসলামি তথা মুসলমান শাসন হিসেবে বর্ণিত, এমন ভাবে যেন যুদ্ধ, রাজ্যজয়, হিংসা ছাড়া ওই আমলে আর কিছু ঘটেনি, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ও উৎকর্ষও না। অষ্টম ও একাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে দেখা গিয়েছে বিপজ্জনক প্রবণতা— ভারতের ইতিহাসের এক-একটি পর্ব হয় মুছে দেওয়া হয়েছে, অথবা বেছে নেওয়া হয়েছে সেই পর্বগুলো, যেখানে শুধুই ‘হিন্দু’ শাসক ও শাসনের গুণ কীর্তিত। দিল্লির প্রথম মহিলা শাসক রাজ়িয়া, বা মোগল আমলে সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ের সর্বময় কর্ত্রী নুরজাহানকে মুছে দেওয়া হয়েছে বই থেকে। অন্য দিকে, অতীতের ভারতে ধর্মস্থান ধ্বংস যে আসলে শাসকমাত্রেরই রাজনৈতিক কৌশলের অঙ্গ ও বিজয়ের চূড়ান্ত চিহ্ন ছিল, তাতে যে হিন্দু-মুসলমানে ভেদ ছিল না, এই সত্যটি বইয়ে উল্লেখমাত্র নেই। দক্ষিণ ভারতে চোল আমলে জৈন মন্দির বা কাশ্মীরে বৌদ্ধ ধর্মস্থান ধ্বংস, কিংবা বাংলায় বর্গি তথা মরাঠা আক্রমণের মতো নানা উদাহরণ যেখানে চোখের সামনে, সেখানে শুধু ইসলামি শাসকদেরই হিংসা-দ্বেষের কারিগর ও কারবারি হিসেবে তুলে ধরলে বুঝতে হবে— এই কাজ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

উদ্দেশ্যটি কী তা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির মূল রাজনৈতিক বয়ানই হল হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ, সেই বিষয়টিই তারা সুকৌশলে ও পরিকল্পিত ভাবে স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের মধ্যেও চারিয়ে দিতে চাইছে। সফলও হয়েছে বলতে হবে, এনসিইআরটি-র প্রকাশিত বই-ই তার প্রমাণ। যে বই ভারতের কোটি কোটি ছাত্রছাত্রী পড়ছে তাকে নিরপেক্ষ হতে হবে, ভালমন্দ যা-ই ইতিহাসে ঘটুক সহজে সেই সত্যকে তুলে ধরতে হবে, এই গোড়ার নীতিটি এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষ লঙ্ঘন করেছেন। তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস যা-ই হোক, ভবিষ্যতের নাগরিকদের উপরে তাঁরা সেই বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে পারেন না, তা ক্ষমাহীন অপরাধ। বইয়ে যা লেখা থাকে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে তা-ই প্রামাণ্য হয়ে ওঠে। ইতিহাসের এই একপেশে সত্য পড়ে আজকের স্কুলপড়ুয়ারাও হিন্দুত্ববাদী ও সংখ্যালঘু-বিদ্বেষী হয়ে উঠুক, এটাই বিজেপির মহাপ্রকল্প। এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষ সেই প্রকল্পটি রূপায়ণেরই পথ করে দিচ্ছেন। রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে শিক্ষা-নিয়ামকদের এ এক ভয়ঙ্কর আঁতাঁত, যার শিকার হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের হয়ে, তাদের জন্য শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকদের এখনই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দরকার, একযোগে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hindu-Muslim Relation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy