গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বা কূটনীতি কোনওটার জন্যই সুসংবাদ বয়ে আনেনি। বৈঠকের ‘সাফল্য’ প্রমাণ করতে যে রাজনৈতিক ভাষ্যই বাজারে ছাড়া হোক না কেন, মোদ্দা কথা হল, ট্রাম্প যা করতে চেয়েছিলেন, সে কাজে তিনি আঠারো আনা সফল— ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের উচ্চাবচতায় কে উপরে আর কে নীচে, বৈঠকের পর তা একেবারে স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান। বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের শক্তির যে তুলনা হয় না, সে কথা প্রশ্নাতীত— কিন্তু, তাকে কূটনীতির মঞ্চে প্রকট করে তোলার মধ্যে একটি আলাদা সুচিন্তিত চাল রয়েছে। ট্রাম্প যে ভাবে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আলাপ চালালেন, তাতে আশঙ্কা সত্য হল যে, অতঃপর ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য সম্পর্ক সম্ভবত আমেরিকার স্বার্থ অনুসারেই পরিচালিত হবে। বৈঠকে স্থির হয়েছে, দুই দেশ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে। বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি বা আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির তুলনায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে সব সময়েই সমস্যা বেশি। আরও বড় কথা আমেরিকার সঙ্গে কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে যাওয়ার পক্ষে বর্তমান সময়টি গোলমেলে। ট্রাম্প প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য চুক্তিরই তোয়াক্কা করছেন না— মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে চুক্তি থাকা সত্ত্বেও সেই দেশগুলি থেকে অ্যালুমিনিয়াম ও ইস্পাত আমদানির উপর আমেরিকা চড়া শুল্ক আরোপ করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিরোধ নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থাটি কার্যত তামাদি হয়ে গিয়েছে। ফলে, আমেরিকা চুক্তির ব্যত্যয় করলেও ভারতের বিশেষ কিছু করার থাকবে না।
ট্রাম্প জোর দিয়েছেন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পারস্পরিক সম হারের শুল্কের উপরে। ভারতের ক্ষেত্রে এই অবস্থানটির গুরুত্ব বিপুল। হোয়াইট হাউস ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, কৃষিপণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে আমেরিকা যেখানে ৫% মোস্ট ফেভারড নেশনস ট্যারিফ আরোপ করে, ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ৩৯%। এ ছাড়াও আমেরিকান মোটর সাইকেলের মতো পণ্য ভারতে ১০০% আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়, সেখানে আমেরিকা ভারতে উৎপন্ন মোটর সাইকেলের আমদানির উপরে মাত্র ২.৪% শুল্ক আরোপ করে। ঘটনা হল, আমেরিকা থেকে ভারত যে পণ্যগুলি আমদানি করে, তার সিংহভাগের ক্ষেত্রেই আমদানি শুল্ক ৫% বা তার কম। এই বাজেটে ভারতের আমদানি শুল্কের গড় হার ১৩% থেকে কমিয়ে ১১% করা হয়েছে। তার পরও হোয়াইট হাউস ব্যতিক্রমী উচ্চ আমদানি শুল্কের উদাহরণগুলি তুলে ধরছে, তার সম্ভাব্য কারণ হল, যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি রূপায়িত হবে, আমেরিকা তাতে নিজেদের পক্ষে সুবিধাজনক শর্ত আরোপের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের অতিরিক্ত আমেরিকা-নির্ভরতাও ভারতকে বিপাকে ফেলছে। এই অবস্থায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি পর্যালোচনা করা কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্যকর্তব্য।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে সামরিক সরঞ্জাম বা প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো পণ্যের পাশে কৃষিপণ্যের বাজারের দিকেও নজর থাকার কথা শোনা গেল। অনুমান, ভারতের কৃষিপণ্যের বাজারে শুল্ক ও অন্যান্য যে বাধা দেশীয় উৎপাদকদের বৈদেশিক প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করে, সেগুলি সরানোর জন্য চাপের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার যে শস্য কেনে সেই বাজারটিও আমেরিকান বিক্রেতাদের জন্য খুলে দিতে চাপ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের কর্তব্য পাল্টা আক্রমণের পথে হাঁটা। আমেরিকা এক দিকে যেমন কৃষকদের বিপুল ভর্তুকি দেয়, তেমনই এই বাজারকে আড়াল করে বিভিন্ন শুল্ক-বহির্ভূত বাধা তৈরি করে। আমেরিকা নিজেই যে কাজটি করে, ভারতকে তার থেকে বিরত করতে চায় কোন অধিকারে, এই প্রশ্নটি তুলে পাল্টা চাপ দেওয়া বিধেয়। বাণিজ্যিক দর-কষাকষিতে বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও না-ছাড়াই প্রথম নিয়ম।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)