ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন— এর মতো কঠিন পরীক্ষা সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতিতে আর দেখা গিয়েছে কি না সন্দেহ। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে জটিল-কুটিল প্রশ্ন যেমন উঠে আসছে, তেমনই বিরোধী রাজনীতিকদেরও নানা লক্ষ্মণরেখা মেনে পদক্ষেপ করতে হচ্ছে। প্রশ্ন কেবল এই নয় যে, ভোটার তালিকায় ভুয়ো নামের ছড়াছড়ি। এত দিনে পরিষ্কার, বহু ভারতীয় নাগরিকের কাছে ভোটার-তালিকায় নাম ওঠানোর মতো কিংবা রাখার মতো যথাযোগ্য নথিপত্রের আত্যন্তিক অভাব। বিহারের খসড়া ভোটার তালিকা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছনোর পর বোঝা যাচ্ছে, তালিকায় প্রভূত পরিমাণ অসঙ্গতি, অথচ তার বিরুদ্ধে আপত্তি বা আবেদন জানানোর সময়সীমা শেষ। যত অভিযোগ উপস্থাপিত, তার বহুলাংশের উত্তরও মেলেনি কমিশনের তরফে, বিরোধী মতে, প্রায় ৮৯ লক্ষ অভিযোগ এখনও উত্তরহীন। কেবল তালিকা নয়, পদ্ধতিতেও গোলযোগ— বিভিন্ন স্থানে নিজের নাম তোলার সঙ্গে অন্যের নাম বাদ দেওয়ার বিপুল উদ্যমে তার স্পষ্ট প্রমাণ। রাহুল গান্ধী ও তেজস্বী যাদব বিহার যাত্রার শেষে সঙ্গত ভাবেই বলেছেন, ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো গুরুতর বিষয়ে এত বড় মাপের অনিয়ম সমগ্র প্রক্রিয়া বিষয়েই গভীর সন্দেহ তৈরি করে। এমতাবস্থায় বিরোধী রাজনীতিকদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত? সহজ উত্তর নেই। রাহুল গান্ধী-তেজস্বী যাদবের জন্য উত্তরহীনতার সঙ্কট যতখানি বাস্তব, তালিকা সংশোধনের পরবর্তী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে তা আরও বেশি।
জাতীয় নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের যে কাজটি করছে, তা কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এবং ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণাধীন। সুপ্রিম কোর্ট এই প্রক্রিয়া বিষয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছে কিন্তু প্রক্রিয়ায় যে-হেতু স্থগিতাদেশ দেয়নি, তাই এই কর্মধারা সাংবিধানিক। সুতরাং, এর সামগ্রিক বিরোধিতা রাজনৈতিক ভাবে সিদ্ধ নয়, বরং প্রক্রিয়ার ভুলত্রুটির দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে চলাই বিরোধী রাজনীতিকের কর্তব্য। ফলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পশ্চিমবঙ্গবাসীকে লক্ষ্য করে বার্তা দেন, ‘কাউকে কোনও তথ্য দেবেন না’, তা সাধারণ মানুষকে এক বিষম বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। কেন্দ্রীয় শাসকের তত্ত্বাবধানে কোনও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চলাকালীন রাজ্যের প্রশাসক যদি এমন অসহযোগের নীতি নিতে বলেন, কেন্দ্র-রাজ্যের দ্বন্দ্বের মধ্যে রাজ্যবাসী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? কী তাঁদের কর্তব্য, কোথায় তাঁদের গন্তব্য, কে তা বলে দেবে? ইতিমধ্যেই রাজ্যের বহু অঞ্চলে ‘কাগজ’-সংগ্রহের উত্তেজনা-উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর অসহযোগের ডাক বিপুল বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক তৈরি করতে পারে, বলার অপেক্ষা রাখে না। শাসক ও বিরোধী— কেন্দ্রে ও রাজ্যে উভয়তই— দলীয় রাজনীতির ফাঁদটিও এর ফলে বিস্তৃততর ও উগ্রতর হতে বসেছে, ইতিমধ্যেই যা মানুষের শ্বাসরোধ করে দেওয়ার উপক্রমকারী।
এই পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ, রাজনীতির উপরে উঠে সাধারণ মানুষের কথা ভাবুন। দেশবাসী কেবল ভোটপাশার ঘুঁটি নন, ক্ষমতাদখলের সিঁড়ি নন, তাঁদের জীবন শুধু রাজনীতিতে উৎসর্গীকৃত নয় বরং সামাজিক অর্থনৈতিক যাপনে ব্যাপৃত— সুখে-দুঃখে আশায়-অনিশ্চয়তায় মেশা তাঁদের দিনরাত। ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া কোনও সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য হতে পারে না। পরদেশিদের শনাক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীর নাম তালিকায় রাখাও যে কোনও ‘নিবিড় সংশোধন’-এর উদ্দেশ্য হওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময় যাতে কোনও ভাবেই প্রকৃত নাগরিকের নাম তালিকা থেকে বাদ না যায়, সেই দায়িত্ব পালন করতে শাসক-সহ সমস্ত রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসবে, এটাই কাম্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)